
আমার বাবা সবসময়ই তার তোশকের তলায় তাঁর সিগারেটের প্যাকেট এবং দিয়াশলাই রাখেন। আমার দেড় বছর বয়সী ভাগ্নি প্রায় প্রতিদিন তার ছোট্ট দুইটা হাত দিয়ে তোশকের নিচ থেকে সে সিগারেট অথবা ম্যাচবক্স নিয়ে বাহিরে ফেলে দেয়। আমার জানা নাই সে এটা বোঝে কিনা যে সিগারেট খাওয়া কোনো ভালো জিনিস নয়, কিন্তু প্রায় প্রতিদিনই এই ঘটনা রিপিট হয়। আমাদের জীবন এরকম আরও অনেক কিছুরই রিপিটেশন ঘটে, যেন আমরা একটা টাইমলুপে আটকে আছি। এই বিষয়টা, সময় নিয়ে খেলবার প্রবণতা আমাদের দেশের যে লেখকের লেখায় আমি সবচেয়ে বেশি দেখতে পেয়েছি, সে হলো শহীদুল জহির। সেই শহীদুল জহিরের ডুমুরখেকো মানুষ এবং অন্যান্য গল্প বইয়ের শেষ গল্প "চতুর্থ মাত্রা" অবলম্বনেই নুরুল আলম আতিক গড়েছেন তার "চতুর্থ মাত্রা"।



একটা কাক যখন আকাশে উড়ে তখন জেনারালি সেখানে তিনটা ডিমেনশন আমাদের চোখে পড়ে। দৈর্ঘ্য (x-axis), প্রস্থ (y - axis) এবং উচ্চতা (z - axis)৷ আইনস্টাইন বলেন এখানে আরেকটা ডিমেনশনও কাজ করে, সেটা হলো ঐ কাকটা ঐ পয়েন্টে কোন সময়ে ছিল (যদিও চতুর্থ মাত্রা নিয়ে এর আগে ল্যাগ্রেং, রাইমেন, হিন্টনসহ আরও অনেকেই কাজ করেছেন) । অর্থাৎ ফোর্থ ডিমেনশন বা চতুর্থ মাত্রা হলো সময়। নুরুল আলম আতিকের " চতুর্থ মাত্রা" ও শুরু হয় পেন্ডুলাম ঘড়ির ঢং ঢং আওয়াজ দিয়ে। পুরান ঢাকার কোনো এক প্রাচীন বাড়িতে অগোছালো দাড়িগোঁফওয়ালা আব্দুল করিম সবসময় তার বাড়ির দরজার সামনে ভাঙা কাঁচের গ্লাস রাখেন যেগুলো দিয়ে পাড়ার ছোট ছেলেরা মিষ্টি কটকটি নিয়ে খায় এবং বড় ভাগ ছোট ভাগ নিয়ে ঝগড়া করে মারামারি করে। এই কারণে কিছু লোক (খুব সম্ভবত ছেলে দুইটার বাবা) আব্দুল করিমের কাছে যায় কেন সে বাড়ির দরজার সামনে ভাঙা কাঁচের গ্লাস রাখে, এবং তারা তাকে গ্লাসের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়াতে বলে এই আশায় যে একদিন আব্দুল করিমের সব গ্লাস শেষ হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে আব্দুল করিমের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে এক পুরাতন পত্রিকা ক্রেতার সাথে যার কাছে আব্দুল করিম তার পুরাতন পত্রিকাগুলো কেজির দরে বিক্রি করতো। এইসব নানা ঘটনা আব্দুল করিমের জীবনে বারবারই ঘটতে থাকে, এবং যখন এই রিপিটেশনের ব্যাঘাত ঘটে, তখনই আবারও প্রচেষ্টা চলে এই স্পন্টিনিটিকে বজায় রাখার। পৃথিবীর এন্ট্রপি বাড়তে থাকলেও, জীবন ক্যাওটিক হলেও মানুষ সবসময়ই একটা ছন্দে চলতে ভালোবাসে।



এবসারডিজম, জাদুবস্তবতা, পরাবাস্তবতা, টাইমলুপ ইত্যাদির জন্যে শহীদুল জহির জনপ্রিয়। সিনেমানির্মাতা নুরুল আলম আতিকের দর্শনেও এসবের ছাপ প্রবল এটা আমরা তাঁর অন্যান্য নাটক সিনেমাতেও দেখতে পাই। সাধারণত সিন রিপিটেশনের উদ্দেশ্য থাকে যেন সিন রিপিট করে সেটা দিয়ে কোনো ইনফরমেশন বা ম্যাসেজ পরিচালক দিতে চান। নুরুল আলম আতিকের উদ্দেশ্য কি ছিল আমি জানি, কিন্তু গল্পটা ক্ষেত্রবিশেষে যে অডিয়েন্সের মাথার উপর দিয়ে যাবে সেটা হলফ করেই বলতে পারি। গল্পের সেটে এবং ক্যারেক্টারদের আউটফিট ছিল একেবারে পারফেক্ট।অসাধারণ সব পজিশনে ছিল ক্রিস হিঞ্জের Monastery, Peaceful Mind, Breathing Wisdom, Prostrations All the Way to Lhasa এবং ইউংচেন লামোর Happiness is..... এর মতো দারুণ সব নেপালি সাউন্ডট্র্যাক এবং মিউজিক। সিনেমাটোগ্রাফিতে দারুণভাবে উঠে এসেছে তৎকালীন দিনের এবং রাতের পুরান ঢাকার দৃশ্য এবং জনজীবন। নুরুল আলম আতিক সবসময়ই আলাদা কিছু করতে চান। সাধারণত স্বপ্নে আমরা দেখি সাদা কালো মোড ইউজ করা হয়, নুরুল আলম আতিক সে জায়গায় ব্যবহার করেছেন সেপিয়া টোন, সাথে আগের সিনেমার মতো কিছুটা ঝিরঝির ভাব। লিড রোল দারুণ ছিল জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, পাশাপাশি ভালো অভিনয় করেছেন তমালিকা কর্মকার, ফজলুর রহমান বাবু। তবে সোনিয়া জাফরের অভিনয় আমার অতো ভালো লাগেনি। তার এক্সপ্রেশন আমার কাছে একটু বেশি এক্সজাজেরেটেড মনে হয়েছে।

আমার জন্মের এক বছর পরে প্রকাশ পাওয়া উদ্ভট সুন্দর এই ফিল্ম উপহার দেবার জন্যে ধন্যবাদ নুরুল আলম আতিক।
Written By:
Arafat Jewel
Comments
Post a Comment