The Curious Case of Benjamin Button ।। আরাফাত জুয়েল
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষদিককার কথা। একজন ঘড়ি তৈরীকারক তার স্ত্রীর সাথে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। ঠিক তখন তার জীবন গল্পের শেষ মূহুর্তের শুরু। খবর আসে যে তার ছেলে যুদ্ধে মারা গেছে। কষ্টে বিহ্বল হয়ে তিনি তার জীবনের শেষ এবং শ্রেষ্ঠ জিনিসটি বানান। একটা বিশাল সুন্দর এবং অদ্ভুত ঘড়ি, যা তার শুরুর সময় থেকে ক্লকওয়াইজ না ঘুরে এন্টিক্লকওয়াইজ ঘুরা শুরু করে। এমন ঘড়ির বানানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে সেই ক্রাফটসম্যান বলেন, তিনি সময়কে পিছনের দিকে নিয়ে যাবার আশায়, সুখী সুন্দর দিনগুলো ফিরে পাবার আশায় যেখানে কোনো যুদ্ধ ছিল না, যখন তার সন্তানের মতো বহু সন্তান তাদের বাবা মায়ের কাছে ছিল, এমন দিনগুলো ফিরে পাবার আশায় তিনি এই ঘড়িটি বানিয়েছেন। নিউ অর্লিন্সের ট্রেন স্টেশনে সেদিন ঘড়িটা যখন চলা শুরু করলো, ঠিক সে সময়ে জন্ম নিল এক অদ্ভুত শিশু, যে জন্ম নেয় এক অশীতিপর বৃদ্ধ শরীর নিয়ে, এবং পাশাপাশি জন্ম হয় একটি প্রশ্নের, যদি কেউ সময়ের বিপরীতে বৃদ্ধ থেকে যুবকে তারপর শৈশবে, এই সময়রেখায় বাঁচতো, তবে কি জীবনের অনিবার্য ক্ষতি বা হারানোর ব্যাথাগুলো মুছে যেত? ডেভিড ফিঞ্চার ২০০৮ সালে এভাবেই শুরু করেন The Curious Case of Benjamin Button.
"জীবন অসীম সুখের হতো যদি আমরা ৮০ বছর বয়সে জন্মাতে পারতাম এবং ক্রমান্বয়ে ১৮ এর দিকে এগুতে পারতাম।" মার্ক টোয়াইনের এই পর্যবেক্ষণ স্কট ফিটযগেরাল্ডকে ১৯২২ সালে তাঁর "The Curious Case of Benjamin Button" লিখতে অনুপ্রাণিত করে। সেই অবলম্বনে ডেভিড ফিঞ্চার তার এই মুভিটি তৈরী করেন। মুভির প্রধান চরিত্র বেঞ্জামিন(ব্র্যাড পিট) জন্মের পরেই তার মাকে হারান। তার বাবা এমন অদ্ভুত সন্তান দেখে স্ত্রীকে দেয়া তার ওয়াদার কথা ভুলে গিয়ে ছেলেকে ফেলে আসেন একটা নার্সিং হোমের সিঁড়িতে, যেখানে কুইনি (টারাজি পি. হেনসন) তাকে খুঁজে পায় এবং এরপর একেবারে নিজের সন্তানের মতো করে বড় করে, বেঞ্জামিনের ক্ষেত্রে ছোট করে।
বেঞ্জামিন জন্মের পর থেকে যত সময় অতিবাহিত হতে থাকে, তত তার শারীরিক গঠন যুবকদের মতো হতে থাকে, যেন তার বয়স আরও কমছে। নার্সিং হোমের সবাই তাকে খুব আপন করে নেয়, বেঞ্জামিন দেখতে থাকে শেষ পর্যায়ে এসে মানুষের জীবনের পরিস্থিতি। মৃত্যু ঐ নার্সিং হোমের প্রায়ই আসা বন্ধুর মতো ছিল। কদিন পরপরই কেউ না কেউ মারা যেত। এমন সময় বেঞ্জামিনের সাথে পরিচয় হয় ডেইজির, যার জন্যে তার জীবন সবসময়ের জন্যে বদলে যায়।
খেলার সঙ্গী হিসেবে ডেইজির সাথে চলাফেরা হলেও ক্রমেই এই বন্ধুত্ব গাঢ় হতে থাকে। একটা সময় বেঞ্জামিন আয়ের উদ্দেশ্যে নার্সিং হোম থেকে বেরিয়ে পড়ে, ডেইজিও চলে যায় নিউ ইয়র্কে। কিন্তু দুজনের সংযোগ খুব একটা কাটেনা। বেঞ্জামিনের পরের জীবন অনেক রোমাঞ্চকর, একটা টাগবোটে সহযোগী হিসেবে সে যোগ দেয়, ঘুরে বেড়ায় অনেক সুন্দর সুন্দর দেশে, বন্দরে, রাশিয়ায় প্রণয় হয় এক ব্রিটিশ ডিপ্লোম্যাটের স্ত্রীর সাথে, সাহসিকতার সাথে যোগ দেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, এবং এরপর আবারও সে ফিরে আসে নিউ অর্লিন্সের নার্সিং হোমে।
পুরোটা সময়ই বেঞ্জামিন ডেইজিকে চিঠি পাঠিয়েছে, ডেইজিও নিউ ইয়র্কে গিয়ে হয়েছে এক বোহেমিয়ান পারদর্শী ব্যালে ডান্সার। কিন্তু ঘটনার পরিক্রমায় ডেইজি এবং বেঞ্জামিনের সহজ ভালোবাসার অনূভুতি জন্ম দিচ্ছিল জটিল এক সম্পর্কে। সময় যেতে থাকে, ডেইজি এবং বেঞ্জামিনের একটা মেয়েও হয়, কিন্তু সে মেয়েকে বড় হতে দেখতে পারেনি বেঞ্জামিন, কারণ বেঞ্জামিনের বয়স এবং সময় দুটোই কমছিল।
অভিনয়ের কথায় যদি আসি, অলমোস্ট সবার অভিনয় খুব নিঁখুত ছিল। শারীরিক অবকাঠামোগত পরিবর্তন এবং আবেগ, অনুভূতি যথার্থভাবে প্রকাশে, মানিয়ে নিতে ব্র্যাড পিট আমার মতে সফল হয়েছে। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়কে ফুটিয়ে তুলেছেন সুনিপুণ অভিনয় দিয়ে। কেট প্ল্যানচেট তার ডেইজি চরিত্রে ছিলেন অসাধারণ। তার বোহেমিয়ান জীবন থেকে শুরু করে ভালোবাসার গভীরতা প্রকাশ, দুর্বল সময়ে হার না মানা, আবার বৃদ্ধকালীন জীবনের অভিনয়, সবকিছু ছিল মাপমতো। টারাজি পি. হেনসনের অভিনয়ে সত্যি আমি মায়ের মমত্ববোধটা অনুভব করেছি।
ফিঞ্চারের ডিরেকশন এবং ক্লডিও মিরান্ডার সিনেমাটোগ্রাফি, এই দুটোর সংযোগ ফিল্মটিকে ভিজুয়াল দিক দিয়ে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। একের পর এক দশক পেরিয়ে যাবার তফাৎ লাইটিং এবং কালার শিফটের মাধ্যমে বেশ ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। বয়স হবার এবং বয়স কমার ক্ষেত্রে যে ভিজুয়াল ইফেক্টগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তা ছিল দারুণ। সেসময়কার কস্টিউম ডিজাইন এবং চয়েজ ছিল প্রশংসনীয়।
The Curious Case of Benjamin Button দেখে বোঝা যায় যে আমাদের জীবন আরও সুখের হতো, ভালো হতো যদি আমরা ভুলতে পারতাম যে জীবন কষ্ট দেয়। হারানোর সবচেয়ে বড় কোপিং ম্যাকানিজম ডিনায়ালে নয়, বরং মেনে নেয়ার মাঝে নিহিত। অনেকটা মুভির টাগবোট ক্যাপ্টেইন মাইকের ভাষায়, "You can be as mad as a dog at the ways things went, you can swear and curse the fates, but when it comes to the end, you have to let go." হ্যা,আমরা সময়ের ধারাই চলি কিংবা সময়ের বিপরীতে, আমাদের জীবনের সাথে জুড়ে যাওয়া যে ঘড়িটা টিক টিক করে ঘুরছে, একদিন তা থেমে যাবে, থেমে যাবে আমাদের ভালোবাসার মানুষগুলোর জীবনঘড়িও। রাস্তায় কত মানুষকে হারাতে হবে। তাই দুঃখে কাতর বিহ্বল হয়তো সাময়ীকভাবে হওয়া সম্ভব, কিন্তু মেনে নেয়ার মাঝেই দিনশেষে প্রশান্তি। আমাদের জীবন অনেক ছোট, সীমিত, এই সময়টুকুতে আমরা যাদের পাশে পাই, তাদের ভালোবাসতে হবে, ক্ষমা করতে জানতে হবে, এবং যতটা পারা যায় জীবনটাকে উপভোগ করতে হবে। ঠিক এমন বার্তাই হয়তো The Curious Case of Benjamin Button দিয়ে যায় বারংবার। যথার্থভাবেই ২০০৯ সালে ৩ টি অস্কার সহ মোট ৮৫টি এওয়ার্ড এবং ১৬০টি নমিনেশন কুড়িয়েছে মুভিটি।
লেখক: আরাফাত জুয়েল
Comments
Post a Comment