ইন দা মিডল অফ "Nowhere" || আরাফাত জুয়েল

 

 ফিল্মের দুনিয়াতে বাজেট একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাজেট বেশি হলে ফিল্ম ভালো হবে এটা সবক্ষেত্রে সত্যি না হলেও অনেক ক্ষেত্রে সত্যি। বাজেটের কারণে অনেক ফিল্মমেকারকেই বরণ করে নিতে হয় তাদের সৃষ্টির করুণ পরিণতি। মোকাবেলা করতে হয় অনেক চ্যালেঞ্জের। তবে এসবের মাঝেও, সুন্দর সাধারণ গল্প এবং অসাধারণ অভিনয় দিয়ে লো বাজেটেও বাজিমাত করে অনেক ফিল্ম। Nowhere এমনই একটা পিস অফ ওয়ার্ক।

 

কোনো এক ডিস্টোপিয়ান রাষ্ট্রের বেহাল দশা। যদিও ফিল্মে ডিটেইলস দিতে অতো আগ্রহ দেখা যায়নি, তথাপি আন্দাজ করা যায় যে রিসোর্সের দারুণ অভাবের জন্যে তারা বেছে নেয় নৃশংস এক প্রক্রিয়া। গর্ভবতী নারী এবং বাচ্চাদের মেরে ফেলে জনসংখ্যা নির্মূলের এক ভয়ানক দৃশ্যপট ফুটে উঠে মুভিটিতে। সেই ডিস্টোপিয়া থেকে নিজেদের এবং অনাগত সন্তানকে বাঁচানোর তাগিদে নিকো (তামার নোভাস) এবং মিয়া (এনা কাস্টিলো) নিজেদের সর্বস্বের বিনিময়ে স্মাগলারদের শরণাপন্ন হয়ে পাড়ি জমাতে চায় আয়ারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। এই ধরণের ঘটনা আমাদের কাছে নতুন নয়। আমাদের দেশের অনেক মানুষই ফ্রড আদম ব্যবসায়ীদের হাতে ভিটে মাটি বেঁচা অর্থ দিয়ে বেআইনীভাবে যেতে চায় অন্য ভূমিতে। কিন্তু যাত্রাপথ মসৃণ হয়না। একইরকম দৃশ্য আমরা দেখতে পাই Nowhere ফিল্মেও। বন্দুকের গুলি, হেলিকপ্টারের সার্চলাইট পেরিয়ে শিপিং কণ্টেইনারে যেতে যেতে একসময় নিকো এবং মিয়া আলাদা হয়ে পড়ে, মিয়া পথে হারায় সব সঙ্গী, এবং ক্রমেই নিজের পেটের সন্তানকে নিয়ে একেবারে একলা হয়ে নিজেকে আবিষ্কার করে সমুদ্রে ভাসমান শিপিং কন্টেইনারে, যার অনেক জায়গায় রয়েছে আবার বুলেটের আঘাতে হওয়া অনেকগুলো ফুটো। এরপরের দৃশ্যগুলো বড্ড টালমাটাল, কখনও হতাশা, কখনও থেমে যাওয়া। অনুভূতির স্কেলের কাঁটার পুনঃপুনঃ উত্থান-পতন।


ফিল্মের বেশিরভাগটাই একটা খুব ছোট সেটে করা, শিপের কন্টেইনারে দিনের পর দিন সংগ্রামের চিত্রগুলো ফুটিয়ে তুলতে ডিরেক্টর এলবার্ট পিন্টো বের করে এনেছেন কাস্টিলোর প্রায় সবটুকু অভিনয় প্রতিভা। এনা কাস্টিলোও হতাশ করেননি। ফিল্মের দৈর্ঘ্য মাঝে কিছুটা মনোটনি সৃষ্টি করলেও, কখনও কখনও গল্প যেন থেমে গেছে এমন অনুভূতি সৃষ্টি হলেও কিংবা শেষটা অনুমান করতে পারা গেলেও কাস্টিলোর দারুণ এক্সিকিউশন চোখ আটকে রাখতে বাধ্য। সিনেমাটোগ্রাফিতে ড্যানিয়েল আরানিউ যেভাবে ক্লোজ শট এবং টাইট ফ্রেমিং দিয়ে মিয়ার হতাশা এবং ক্লস্ট্রোফোবিয়াগুলাকে তুলে এনেছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে। এই মুভির ডিটেইলগুলো অনেক সূক্ষ্মতার সাথে খেয়াল রাখা হয়েছে। মিয়ার সংগ্রামের চিত্রগুলোকে ক্যামেরায় ধারণ করা, কন্টেইনারের ভেতরে আশা এবং হতাশার মূহুর্তগুলোতে লাইটিং কন্ট্রাস্টের খেলা, কিংবা সাগরের এম্বিয়েন্ট সাউন্ডগুলোর মাঝে কন্টেনাইনারের ক্রিক ক্রিক বা গর্জনের আওয়াজ, প্রতিটা ডিটেইল যেন খুবই যত্নের সাথে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।


এক অনিশ্চিত এবং ঠিক ভুলের দোটানায় থাকা নিকো মিয়ার এই দম্পতির আলাদা হওয়া থেকে শুরু করে ক্রমেই ক্লস্ট্রোফোবিক সিচুয়েশনে টিকে থাকার লড়াইয়ে সময়টাতে অনেক বার্তাই সামনে এসেছে। আমরা হতাশায় ভোগা একটা জীব। আমাদের জীবন সংগ্রামে ভরা। কিন্তু মানুষ তার সবচেয়ে খারাপ, কঠিন সময়টাতেও বাঁচতে পারে, যদি তার সাথে থাকে একটু বুদ্ধি, ধৈর্য, এবং আলোর আশা। সন্তানের জন্যে মিয়ার যে অর্ডিয়াল, তা আমাদের কাছে আবারও পরিষ্কার করে দেয় আমাদের বাবা মায়ের কষ্ট, সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখতে, ভালো জীবন দিতে তারা সবটুকু করতে পারে, জীবন যদি একটা ল্যাব হয়, সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখতে বাবা মায়েরা হতে পারেন বিজ্ঞানী, যাঁরা তাদের সবটুকু অভিনবত্ব ও প্রচেষ্টা দিতে কুন্ঠা বোধ করেন না।

লেখকঃ আরাফাত জুয়েল

 


Comments

Popular posts from this blog

চতুর্থ মাত্রা ।। আরাফাত জুয়েল ।। দেবস্মিতা সাহা

The Curious Case of Benjamin Button ।। আরাফাত জুয়েল