তকদীরঃ একটি সার্থক ওয়েব সিরিজ
'তকদীর' এর জনরায় লিখা আছে রহস্য এবং থ্রিলারের কথা। 'তকদীর' থ্রিলার হিসেবে ভালো হলেও সম্ভবত এটাকে রহস্য ড্রামা বলা চলে না।
আলাপ করছি সম্প্রতি ওটিটি প্লাটফর্ম 'হইচই' এ রিলিজকৃত এবং আলোচনার তুঙ্গে থাকা ওয়েব সিরিজ 'তকদীর' নিয়ে। ৮টি পর্বের দীর্ঘ তিনঘন্টার এই ওয়েব সিরিজের উপভোগ্য ব্যাপার হলো পরিণত তারকাদের সাথে উঠতি তারকাদের অসম্ভব সুন্দর রসায়ন। প্রতি চরিত্রই প্রাসঙ্গিক, অপ্রয়োজনীয় রোল প্লে নেই এবং পুরো সময়জুড়েই ইকোসিস্টেম এর সাথে ক্যামেরার একটা ফাংশন আপনার নজর কাড়বে।
শাওকি পরিচালিত এই ওয়েব সিরিজটি আলোচনায় আসতে হতো ট্রেলার দেখেই। ধর্ষণ, লাশ এবং চঞ্চল চৌধুরীর কিছু একটার জন্য অপেক্ষায় থাকার অভিব্যক্তি জানান দিচ্ছিল কিছু একটা ব্যতিক্রমী হবে। প্রথম পর্বই শুরু হয় একজন ধর্ষিতার জবানবন্দি রেকর্ডের দৃশ্য দিয়ে। তখনো আসলে বুঝা যাচ্ছিল না গল্পটা ঠিক কি নিয়ে, কিংবা পরিণতি রুপ নিতে যাচ্ছে কোনদিকে। তারপরের দৃশ্যেই এসে উপস্থিত হয় এই সিরিজের মূল উপজীব্য সেই লাশ। লাশকে কেন্দ্র করেই একের পর এক নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ হতবিহ্বল করে দিতে থাকে তকদীরকে, অন্যদিকে লাশকে ঘিরে একটা সাসপেনশন জমতে থাকে লাশকেন্দ্রিক সকল ক্যারেক্টারের মাঝেই৷ মূলতঃ একজন নারী সাংবাদিকের একটা রিপোর্ট তৈরি থেকে সেটা পত্রিকায় পাবলিশ হওয়া অবধি নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়েই নির্মিত 'তকদীর'।
'তকদীর' এর গল্পটায় একইসাথে আমাদের সামাজিক জীবনে পলিটিক্যাল ইনফ্লুয়েন্স, সামাজিক শান্তি বিনষ্টের পিছনের প্রোপাগান্ডাসমূহ এবং সমাজে প্রায়ই যেসকল শান্তি বিনষ্টকারী ঘটনা ঘটে সেসব যে ভিন্ন এক পারপাস সরবরাহ করে সেটা এই সিরিজে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন পরিচালক। এটা চ্যালেঞ্জিং কাজ, সাহসিকতারও বটে। এই সিরিজ আবার আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের চিরাচরিত আইনের কাছে আমরা কতবেশি সীমাবদ্ধ, আবার এই আইন কতবেশি জটিল হতে পারে যার কারণে যাদের জন্য আইন সে জনগণের ভেতরই আইনকে এড়িয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বাঁচার একটা প্রবণতা তৈরি হয়ে আছে। নিঃসন্দেহে এই গল্পটা দর্শককে ভাবনায় ফেলার মত। আমাদের ব্যক্তি-সামাজিক জীবনে ধর্মের একটা নিগুঢ় ছায়া কিংবা নগর জীবনে আমাদের ব্যক্তিগত শূণ্যতা ব্যাখ্যা করতে এই গল্প সক্ষম। কিন্তু গল্পের সাথে চিত্রনাট্যের যদি তুলনা করতে হয় তবে চিত্রনাট্য গল্প অনুপাতে কিছুটা কম শক্তিশালীই বলতে হয়। বেশ কিছু খুঁত চোখে পড়ার মতনই। চিত্রনাট্যে গুলশান থানায় জিডির কথা বলা হলেও দৃশ্যে দেখা গেছে শ্যামলী থানা, এই গল্পের উল্লেখযোগ্য ক্যারেক্টার ফটোগ্রাফার রানার পরিণতি, পলিথিনে পেঁচিয়ে ফেলায় রীতিমতো মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যাওয়া পার্থ বড়ুয়ার আবার খুব দ্রুত উঠে গিয়ে লাশগাড়ির চাকায় টার্গেটেড শট করা কিংবা মন্টুকে শটডেড করার মতো শক্তি পাওয়াটা চিত্রনাট্যকে কিছুটা ভারসাম্যহীনই করে দিয়েছে বলা চলে। আবার জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হওয়া একটা লাশগাড়ি যার চালক-মালিক সকলেই যেখানে খবরের অংশ সেখানে এই লাশগাড়ি নিয়েই তকদীর তথা চঞ্চল চৌধুরী মেইন রোডে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করছিলেন অথচ কোনো চেকপোস্ট এর মুখে পড়তেই দেখা গেল না চিত্রনাট্যে। আবার মুখ থেকে মেমরি কার্ড বের করাটা এত সহজেই যখন হল, তখন গল্পের বাকিসব থ্রিলই অর্থহীন হয়ে যায়। এছাড়াও আরো বেশকিছু জায়গায় সাসপেন্স তৈরি করেও সেটাকে পরে আবার খুব দ্রুতই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে দেখা গেছে।
স্ক্রিনপ্লে ছিল মনোরোম। এক কথায় নজরকাড়া। দারুণ সব ক্যামেরার কাজ, সুন্দর এডিটিং। বিশেষ করে বলতে হবে ফ্রেম এর কাজ। প্রতিটি ফ্রেমই ছিল যথাযথ। লাইটিং ছিল এক কথায় পূর্ণাঙ্গ। এমন কাজ দেখলেই দৃশ্যত ভালো লাগে। উপভোগ করা যায়। লাইটিং এক্সপোজার, কালার টেম্পারেচার এর সাথে যে বিষয়টির কথা না বললেই নয় তা হলো মিউজিক এবং সাউন্ড। এত ভাবগাম্ভীর্যতাপূর্ণ সাউন্ড, ফেরিতে সাইরেন এর আওয়াজ, মাল্টিডাইমেনশনাল ফ্রেমিংগুলোয় ভয়েস এবং মিউজিকের অসাধারণ মিক্সিং দৃশ্যগুলোকে জীবন্ত করে তুলেছিল। কিন্তু, ওই যে চিত্রনাট্যে সূক্ষ্ম কিছু ভুল, সাসপেনশন তৈরি করতে গিয়ে অযথা কিছু সময় টেনে নিয়ে যাওয়ার কারণে একদম খাপে খাপ ঠিক বলা যাচ্ছেনা। তারপরও, শাওকি এবং তার দলের এই কাজকে সুন্দর বলা চলে সাবলীলভাবেই।
এই সিরিজে পার্থ বড়ুয়ার 'হিটম্যান' ক্যারেক্টারটা ইন্টারেস্টিং৷ তার বাচ্যভঙ্গি, লুক, আই কন্টাক্ট, হাসি, সালামের বদলে নিজস্ব স্টাইলে 'আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক' বলা, একটা মিস্ট্রিয়াস এবং হরাইবল ক্যারেক্টার হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারা সবকিছুই বেশ সুন্দর। অনেক বেশিই সুন্দর।
চঞ্চল চৌধুরীও 'তকদীর' চরিত্রে জাত চিনিয়েছেন নিজের। তার সহিষ্ণু মনোভাব, অন্যের অমঙ্গল কামনা না করার অভ্যাস, কিংবা ইউজুয়াল বাঙালি কোনো পাড়ার আড়তের নেতার মত সবার মন যুগিয়ে চলতে পারা, নিজের অতীতের কষ্টের কারণে চেহারায় একটা স্পষ্ট বিষাদ তার অভিনয়কে প্রশংসাযোগ্য করে তুলেছে। যদিও তার অভিনয়ের চাইতেও বেশি প্রভাবশালী অভিনয় হয়ে উঠেছে মন্টু চরিত্রে সোহেল মন্ডলের অভিনয়.
Manoj Pramanik একজন পরিণত অভিনেতা। রানা চরিত্রে তাকে ঘিরে বিশেষ কিছু বলার নেই। এই গল্পে তার চরিত্রটাই কিছুটা কনফিউজড করার মত চরিত্র৷ যে বারবার দ্বিধায় ভুগে, কাউকে বিশ্বাস করা যার জন্য শক্ত বটে। এর পাশাপাশি তিনি একজন প্রতিশ্রুতিশীল কলিগ, যার কাছে তার প্রিয় একজন কলিগের হত্যা দেখা এবং মৃত্যুর পর নানারকম বিভীষিকার চাক্ষুষ সাক্ষী হওয়াটা দুঃস্বপ্নের মতই।
কিন্তু শুরুতে তকদীরকে তিনি যে অজ্ঞাত পরিচয়ে কল করে প্রভাব বিস্তার করছিলেন, সেই তিনি আবার পরবর্তীতে এত প্যারাডক্সে ভোগাটা চিত্রনাট্যের দূর্বলতা বলতে হয়।
সাংবাদিক আফসানার চরিত্রে সানজিদা প্রিতি দারুণ ছিলেন। সেই সাথে সাহসী নারী হিসেবেও। তার চরিত্রে একটা পেশাদারীত্ব ফুটে উঠেছে স্পষ্ট। সেই সাথে তার অন্যদের সাথে ডিল করার ব্যাপারটিও। তিনি ভূয়সী প্রশংসার দাবীদার৷ তার সাথে চেয়ারম্যান চরিত্রে ইন্তেখাব দিনার এবং সাংবাদিক হিসেবে সাকিব চরিত্রটিও ইন্টারেস্টিং।
'তকদীর' ওয়েব সিরিজ এমন একটা সময়ে রিলিজ দেয়া হয়েছে যখন বাংলাদেশে আমরা এখনো আদর্শ ওয়েব সিরিজ বলতে কোনোটিকে নির্ধারণ করতে পারিনি। এতদিন অবধি ওয়েব সিরিজের নামে যা হয়েছিল সেসবকে একেকটা নাটককে ১৫/১৬ মিনিটের কিছু খন্ডে ভাগ করে দেখানো ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। সেন্সরশীপ না থাকাই অনেকেই নিজের মতো করে একেকটা কাজ করে চলেছিলেন, কিন্তু সবজায়গাতেই খাপছাড়া একটা ভাব বিদ্যমান ছিল। ওয়েব সিরিজের সাথে অন্য যেকোনো কাজের একটা পার্থক্য এর আগে তৈরি হয়নি বাংলাদেশে। সে জায়গায় 'তকদীর' একটি সার্থক এবং পূর্ণাঙ্গ ওয়েব সিরিজ বলা যায়। কেন বলা যায় তার ব্যাখ্যা পেতে হলে আপনি আগে 'তকদীর' দেখুন, ভাবুন তাকে সিনেমা হিসেবে কেমন দেখায়, নাটক হিসেবে কেমন দেখায় কিংবা ধারাবাহিক নাটক হিসেবে কেমন? আপনি মিলাতে পারবেন না। তাকে ওয়েব সিরিজেই সবচেয়ে সুন্দর মনে হবে।
তাই বলছি, 'তকদীর' একটি মৌলিক এবং সার্থক ওয়েব সিরিজ।
Written By: Saeed Khan Shagor
Edited by: Ankon Dey Animesh
Comments
Post a Comment