ধনঞ্জয় মুভি, মব জাস্টিস ও ভাবনা
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাটা যতটা ইম্পর্ট্যান্ট তার মতই ইম্পর্ট্যান্ট প্রকৃত ভিক্টিমকে সেটা চিহ্নিত করা; ইম্পর্ট্যান্ট সবার বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করা।
কেবলমাত্র অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী না হওয়াটার কারণে আমাদের ভেতর যে শ্রেণিবৈষম্য গড়ে উঠে; যে কাউকেই দোষী সাব্যস্ত করা যায়, যেকোনো লোককে দিয়ে খেলানো যায় ভিকটিম কার্ড তার সবচাইতে চাক্ষুষ প্রমাণ গতকাল টিকটকার অপুভাইয়ের সাথে হতে দেখেছেন। হিরো আলম/অপুভাই এই মানুষগুলোই বাংলাদেশের বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। শুধুমাত্র গ্রামের ছেলে/অশিক্ষিত/গরীব হওয়ার কারণে তাদের চুল নিয়ে কুল জেনারেশনের অস্বস্তি, তাদের কাজের বিরোধিতার বদলে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের বিরোধিতা আমরা করছি। অথচ সেম ক্যাটাগরিরই সালমান মুক্তাদির/ অনন্ত জলিলদেরকে আমরা প্রমোট করছি, করতে না পারলেও বা করতে না চাইলেও তাদের সোশ্যাল ভ্যালুজ তৈরি হওয়ায় আমরা তাদের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিচ্ছি। অপুভাইয়ের সোশ্যাল ভ্যালুজ তৈরি না হওয়ার কারণেই পুলিশের কাছ থেকে তাকে কেড়ে নিয়ে মারতে পারছি, হিরো আলমকে সংসদ নির্বাচনে যাচ্ছেতাই ভাবে গায়ে হাত তুলতে পারছি। অথচ কথা ছিল তাদের কাজগুলোর প্রফেশনালিজম বা ভ্যালিডিটি নিয়ে প্রশ্ন তোলার। তাদের এই ইনকারেক্ট সোশ্যাল লেভেলে থেকে কাজগুলো নিয়ে আপনি এতই ইর্ষান্বিত বা এতই অস্বস্তিতে পড়ছেন যে অপুভাইকে ক্রসফায়ার দিতে বলছেন কমেন্টে। হায়েনার মতো উল্লাস করছেন তার আইডি বন্ধ হওয়ার খবরে; অথচ তার আইডি বন্ধ হওয়ার মূল পদক্ষেপ কোনো অথরিটারিয়ান নেয়নি।
মব জাস্টিসের ক্ষতিকর দিক হলো এটি আইনকে আইনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। বিচারকার্যকে ভায়োলেটেড করে, পপুলিজম দ্বারাই চিহ্নিত হয়ে যায় কে দোষী বা নির্দোষ। কোথাও একটা গিয়ে প্রশ্নবোধক চিহ্ন টেনে দেয় বিচারব্যবস্থার উপরে।
যাকগে সেসব কথা। 'ধনঞ্জয়' মুভিটাও তেমনি কেবল গরীব মানুষ হওয়ায় এক বাড়ির কেয়ারটেকারের মিথ্যা মামলায় ফাঁসি খাওয়ার গল্প। তার জবানবন্দি শোনার কিংবা তার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগটাও যে বিচার ট্রায়ালে পায়নি। এবং যতটুকু শুনেছি এই মুভি সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে নির্মিত। পরবর্তী অনেকবছর পরে এক ঘটনায় আইনজীবীর চোখে পড়ে তার বিচার নিয়ে প্রহসনের ঘটনা। এই ঘটনার তদন্ত আর ফাঁসির যুক্তি যাচাই করতে যাচাই করতে গিয়ে আইনজীবী জড়িয়ে যান অনেক ঘটনাপ্রবাহের সাথে।
একজন মৃত ব্যক্তির বিচারপ্রাপ্তিকে বদলে নতুন করে নির্দোষ প্রমাণে আসলে বিশেষ কিছু যেতো আসতো না, কিন্তু নতুন করে ওই বিচারের প্রশ্নগুলো উঠে আসাতে কিছুটা হলেও টনক নড়ে সব প্রশাসনে।
যে ঘটনাগুলো ধনঞ্জয়ের বিরুদ্ধে যায় সেগুলো হল( সূত্র- 'আদালত মিডিয়া সমাজ এবং ধনঞ্জয়ের ফাঁসি')
১) খুনের কাছাকাছি সময়ে ধনঞ্জয়কে হেতল পারেখদের ফ্ল্যাটের আশপাশে দেখা গিয়েছে
২) খুনের পর সে নিরুদ্দেশ হয়েছিল
৩) এই দুই ব্যাপারে ধনঞ্জয় আদালতে সত্যি কথা বলেনি।
যে ব্যাপারগুলো হেতালের মা ও পারেখ পরিবারের বিরুদ্ধে যায়, সেগুলো একবার দেখে নেওয়া যাক ( সূত্র- 'আদালত মিডিয়া সমাজ এবং ধনঞ্জয়ের ফাঁসি')
১) হেতল খুন হয়েছিল ফ্ল্যাটের মধ্য়ে। দুপুরের পর খুনের সম্ভাব্য সময়ে সেখানে হেতালের মা ছাড়া আর কেউ উপস্থিত ছিল বলে প্রমাণ নেই। এই যুক্তিতে হেতলের মা-কেই মূল সন্দেহভাজন বলে ধরতে হবে।
২) ধনঞ্জয়কে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়েছিল, শুধুমাত্র ফ্ল্যাটের ভিতরে তার উপস্থিতির তথ্য ছিল মিথ্যা সাক্ষ্য প্রমাণের ওপর দাঁড়িয়ে।
৩) বাড়ির লোক ছাড়া কারও পক্ষে অল্প সময়ের মধ্যে ওই কাণ্ড ঘটিয়ে চোখে না-পড়ার মতো চেহারা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া কঠিন।
৫) মৃতদেহ সকলের সামনে "আবিষ্কার" হওয়ার আগে ফ্ল্যাটের সদর দরজা ভাঙার জন্য হেতলের মা বড্ড তাড়াহুড়ো করেছিলেন। যেন তিনি জানতেন দরজার ওপারে জীবিত কেউ নেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা আর ইন্টারকম কিংবা টেলিফোনে মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা তিনি করেননি।
৬) মৃতদেহ দেখেই হেতলের মা একা হাতে পাঁজাকোলা করে সেই দেহ তুলে নিয়ে হাসপাতালে যাবেন বলে লিফটে ওঠেন। একতলায় পৌঁছেও তিনি লিফটের মধ্যে একঘণ্টা ঠায় বসেছিলেন কী কারণে। সদ্য যে মারা গিয়েছে তার দেহ নিয়েও এই আচরণ স্বাভাবিক নয়।
৭) হেতলের খুন 'আবিষ্কার' হওয়ার পর পুলিশ ডাকতে তিন ঘণ্টারও বেশি দেরি করে পারেখ পরিবার। তার আগে মৃতদেহ বহুবার টানাহ্যাঁচড়া আর খুনের জায়গা দিয়ে বহু লোক চলাফেরা করেছে।৮) পুলিশ আসার পর হেতলের মাকে কিছুটা আড়াল করা হয়েছিল, যদিও খাতায় কলমে খুনের অভিযোগকারিণী তিনিই। খুনের দিন সাতেকের মধ্যে হেতালের মাকে মুম্বই পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
৯) হেতলের মা ৪ বার অসুস্থতার অজুহাতে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া এড়ান। তার মধ্য়ে দুবার তিনি আদালতে হাজির থেকেও সাক্ষ্য দেননি ১০) ধনঞ্জয়ের বাড়ি থেকে যে হাত ঘড়ি আদতে উদ্ধার হয়নি, তেমন একটা সাজানো ঘড়ি হেতালের মা লালবাজারে গিয়ে সনাক্ত করে আসেন সিরিয়াল নম্বর না মিলিয়েই। পরে পারেখরা চিঠি দিয়ে আদালতের কাছে সাড়ে তিনশো টাকার সেই ঘড়ি ফেরত চান।
১১) পুলিশ অকুস্থলে পৌঁছনোর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্য়ে ধনঞ্জয়কে পলাতক এবং সম্ভাব্য অপরাধী বলে ঘোষণা করে দেওয়ার পিছনে পারেখ পরিবারের হাত ছিল।১২) ধনঞ্জয় কেন খুন করে থাকতে পারে, তার একটা কারণ দাঁড় করানোর জন্য জাল নথিপত্র তৈরিতে হেতালের বাবা অংশ নিয়েছিলেন। হেতলকে ধনঞ্জয়ের উত্যক্ত করার গোটা "কাহিনী" পুলিশকে জানিয়েছিল তার বাড়ির লোক। আার কেউ এব্য়াপারে কিছুই জানত না।
১৩) পারেখ পরিবারের তরফে হেতলের মায়ের বাড়ি থেকে বেরনো আর হেতলের বাবার বাড়ি ফেরার সময়ের বিকৃত তথ্য পুলিশকে দেওয়া হয়। আদালতেও সেই বিকৃতি বজায় রাখা হয়।
১৪) হেতলের পেটে হজম না-হওয়া যে খাবার পাওয়া গিয়েছে, তাতে খাওয়ার পর (বা খাওয়া চলতে চলতে) মায়ের সঙ্গে সংঘাতে খুন হওয়ায় তত্ত্বের সমর্থন মেলে।
বিচারক এই হত্যাকান্ডকে ঘোষণা করেছিলেন 'রেয়ারেস্ট অব দি রেয়ারেস্ট' নামে।
এসভিএফ এর প্রযোজনায় এই মুভিতে যখন অনির্বান তথা ধনঞ্জয় তার মাটির বাড়িতে লুকোন পুলিশের ভয়ে সে মুহুর্তের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আপনাকে শিহরিত করবে। কিংবা ধনঞ্জয়ের স্ত্রীর চুপচাপ কান্না আর সেটা মিমি তথা আইনজীবীর চোখে ধরা পড়ার ওই সময়ে ক্যামেরার ফ্রেমিংটা এই মুভিকে আমায় এখনো মনে করিয়ে দেয়। কৌশিক সেন আর মীর আফসার আলী পরিণত এবং পেশাদার দু'জন অভিনেতা৷ তারা পেশাদারীত্বের সাক্ষর রাখেন এখানটায়ও।
এই মুভির চিত্রনাট্য সম্ভবত ইতিহাসের ছায়া থেকে নেয়া না হলে এত ভালো হতে পারতো না। আমরা যা কিছু নিজেদের মতো বানাই সবই কি রিয়েলিটির মত নিখাদ হয়? সম্ভবত হয় না। রিয়েলিটির ভিজ্যুয়ালাইজেশন সেদিক থেকে তুলনামূলক সহজ।
মুভির এন্ডিং পার্টটা এই মুভিকে গড়ে তুলেছে পূর্ণ। আর অবশ্যই সুন্দর।
মুভির এই রিভিউ এমন সময়ে লিখছি যখন বাংলাদেশে ঘটে গেছে চাঞ্চল্যকর এক ধর্ষণ (?) এর পরের মৃত্যু (?)। এই মৃত্যুর সঠিক বিচার প্রয়োজন আইনকে তার মতো করে চলতে দেয়ার নিমিত্তে। আর তারই জন্য মব জাস্টিস নিয়ে ভাবার আগে আমাদের ভাবা উচিত বিচারকার্য স্বাধীনভাবে হচ্ছে কিনা।
আর অবশ্যই মাথায় রাখা উচিত, ধনঞ্জয়ের মব জাস্টিসের মৃত্যুটা একই সাথে ওই হেতালের মৃত্যুর প্রতিও অবিচার ছিল। সঠিক বিচার হোক প্রতিটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর।
Written By: Saeed Khan Shagor
Re Edited, Organized and Published By: Ankon Dey Animesh
Fantastic Comparative and critical analysis!
ReplyDeleteExcellent thinking. Overall it's awesome.
ReplyDelete