কষ্টনীড়ঃ একটি হইচই অরিজিনালই বটে
১৫ই জানুয়ারি ওটিটি প্লাটফর্ম হইচইয়ে মুক্তি পেয়েছে 'কষ্টনীড়'। ৯৯মিনিটের একটি কাজ। যদি সুস্পষ্টভাবে বলতে হয় তবে তাকে সোশ্যাল ড্রামা বলা যায়। আর পরিচালনা করেছেন যিনি, তিনিই এটাকে কেবলই 'হইচই অরিজিনাল' হিসেবে অভিহিত করতে চেয়েছেন।
একটা পরিবারের পাঁচটি ছেলেমেয়েকে নিয়ে গল্প সাজিয়েছেন আশফাক নিপুন, চিত্রনাট্য দাঁড় করিয়েছেন আশফাক নিপুন এবং পরিচালনা করেছেন আশফাক নিপুন যেখানে পাঁচজন সন্তানই ভিন্ন ভিন্ন স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী। গল্পে যাওয়ার আগে চরিত্রগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেই।
এই ড্রামার শক্তিশালী চরিত্র হলো তারিক আনাম খান। যিনি একটি পরিবারের কর্তা, মেজাজি, একরোখা। সাবলীল চরিত্রে তার মতো করে তিনি ক্যামেরায় হাজির হয়েছেন। স্টোরিলাইনের বাইরে এর চেয়ে বেশি কিছু দেয়ার ছিল না আসলে।
ফ্যামিলির বড় ছেলের চরিত্রে সায়েদ বাবু খুব বেশি সাবলীল ছিলেন না। একটা খাপছাড়া ব্যাপার ছিল। তার রোল যেভাবে প্লে করার কথা সে অনুযায়ী তিনি ততটা গল্প এবং সংলাপনির্ভর হতে পারেন নি। মার্জিনালাইজ অভিনয় ছিল এবং তা চোখেও পড়ছিল।
সাবিলা নুরের চরিত্র কমপ্লেক্সুয়াল। এমবিশাস একজন তরুণী যে স্বনির্ভর হতে ভালবাসে। রক্ষণশীল পারিবারিক কাঠামোর ব্যারিয়ার গুলোকে যে ভাঙতে চায় না ঠিক, তবে খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধও করতে পারেন না। চরিত্রটা ইন্টারেস্টিং, আর তিনি নিজেকে গুছাতেও পেরেছেন সেভাবে।
শ্যামল মাওলা বাম রাজনীতি করা একজন যুবক। বিপ্লব-রাষ্ট্র-সমাজ এই নিয়ে তার ধরা-সরা জ্ঞান। বিপ্লব নিয়ে তার রেটোরিক তাকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে পরিবার থেকে। যে কারণে পরিবারের আর সবার সাথে একটা অস্পষ্ট দূরত্ব জমে আছে তার। এমন একটা চরিত্রে শ্যামল মাওলা পারফেক্ট চয়েজ। তার মুখাবয়ব, কথা বলার ভঙ্গি, অগোছালো জীবনের প্রতি অভ্যস্ততা আর পপুলিস্ট কথাবার্তা নির্ভর প্রতিটি সংলাপই তার প্রমাণ দিয়ে যায়। তবে সম্ভবত এই অভিনয়ে তিনি স্বাতন্ত্র্যবোধ জাগাতে পারেন নাই। অবশ্য জাগাতে গেলে চিত্রনাট্যের সাথে স্ক্রিনিংয়ের একটা গোঁজামিলও তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
রুনা খান একজন ভালো অভিনেত্রী। ইতোমধ্যেই তিনি তার প্রমাণ দিয়েছেন। কষ্টনীড়ে তার অভিনয় ভালো, কিন্তু সেরা নয়। তার অভিনয়টা সংলাপের চেয়ে এক্সপ্রেশন নির্ভর ছিল। তার সংলাপ ভালভাবেই দিয়েছেন তিনি, কিন্তু এক্সপ্রেশনে খুঁতখুঁতানির ব্যাপার ছিল কেমন যেন। বেশ কিছু জায়গায় তার সংলাপের সাথে এক্সপ্রেশনের গরম মাসালা ঠিকঠাক মিশেল না হওয়া স্পষ্ট।'কষ্টনীড়' এর শক্তিশালী চরিত্র ইয়াশ রোহান। একজন মাদ্রাসা স্টুডেন্ট যে একই সাথে এক্সট্রিমিজম আর নিওলিবারেলিজম এর দোটানায় ইসলামের সৌন্দর্য নিয়ে সন্দিহান। তার কাজটাও এক্সপ্রেশন নির্ভর ছিল, সংলাপ নির্ভর নয়। প্রতিটি দৃশ্যেই তিনি সাবলীলতার পরিচয় দিয়েছেন। তার লুকটাও অসাধারণ। কিন্তু এই জায়গায় এসে একটাই ব্যাপার চোখে পড়ে, তা হলো ইয়াশ রোহান যখন জঙ্গীটাইপ লোকটার সাথে সময় কাটাচ্ছিলেন তখন তার সব কথাই অকপটে মেনে নেওয়ার বা মৌন সম্মতির প্রবণতা ছিল। সেটা থাকতেই পারে, কিন্তু ওই যে তিনি প্যারাডক্সে ভুগছিলেন; তার সাথে এটার কম্বিনেশন পাওয়া যায় না। ফাংশনটা অনুপস্থিত।
আশফাক নিপুন গল্পটা সাজিয়েছেন দারুণভাবে। দেখুন, আমরা প্রত্যেকেই ঘর-মন-জানালায় কোনো না কোনোভাবে পলিটিক্যাল। অবশ্যই আমরা কোনো একটা আইডিওলজিকে ধারণ করি; এমনকি আমাদের মনের অজান্তে হলেও। আমাদের পলিটিক্যাল ধারণা অন্য সকল কিছুর সাথে সাথে পারিবারিক জীবনকেও প্রভাবিত করে। করাটা স্বাভাবিক। সে জায়গায় এসে আশফাক নিপুন একদম রিলাক্সেশনের সাথেই কেবল আমাদের এই সময়টাকে ক্যামেরায় গেঁথেছেন। হ্যাঁ, ন্যারাটিভ থেকে এটা খুবই সাধারণ গোছের। কিন্তু মনে রাখার মতোন। কর্পোরেট ডিলিংয়ে যখন কেউ কেউ ব্যস্ত, তখন আর কেউ দিব্যি স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে বিপ্লবের। ব্যস্ত সময় পার করছে সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংসের চিন্তায়। একই সাথে পলিটিক্যাল ইসলাম দু'টো মেরুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এক্সট্রিমিজম আর মডারেশনাল। নগরজীবনে আস্তে আস্তে একটা নতুন দিকে আগাচ্ছে পরিবার প্রথা যেখানে বন্ডিংগুলো হালকা হয়ে আসছে, দিবালোকের মতন পরিষ্কার জেনারেশন গ্যাপ । এইইই তো। এটাই তো একবিংশ শতাব্দীর প্রথম বিশ বছর। আশফাক নিপুন কেবল এই চারটে ব্যাপার নিয়েই সাজিয়েছেন 'কষ্টনীড়'।
ক্লোজ শট ছিল হাতেগোণা, কিন্তু ভালো। লংশটগুলোর ফ্রেমিং আর এংগেল ভাগ করাটাও পারফেকশন দেয়। শ্যামল মাওলাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার সময়ে উপরের তলায় দাঁড়িয়ে তারিক আনাম খানের তাকিয়ে থাকার দৃশ্যে ক্যামেরার যে মুভমেন্ট সেটা দারুণ। গল্প ভালো, স্ক্রিনপ্লে দারুণ, এডিটও মনোরোম। শুধু স্ক্রিপ্টের সাথে স্ক্রিনিংয়ের কিছু গ্যাপ থেকে গেছে এইই যা। আর অবশ্যই তার এন্ডিংটা গৎবাঁধা, খুবই কমন। 'অতঃপর, তারা শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো' ধরণের এন্ডিং এই গল্পের শুরু থেকে যে একটা চোখ না সরানোর ব্যাপার তা কমিয়ে দেয়। এন্ডিং নিয়ে অবশ্যই আরেকটু ভাবতে পারতেন নির্মাতা।
'কষ্টনীড়' এর আরেকটা খেয়াল করার মতো দিক হল নয়েজ। হ্যাঁ, অনাড়ম্বর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক যার পুরোটাই সফট তার সাথে সাথে নজড় কাড়বে আমাদের আশেপাশের নয়েজটাও। খুব সুন্দর করে ধারণ করা গেছে সাউন্ড। ভাবগাম্ভীর্যযুক্ত সাউন্ড এর বাইরে গিয়ে এই নয়েজিংটা কাজটাকে করেছে আরো সাধারণ এবং আরো নজড়কাড়া। আর সাথে সাথে বইয়ের ভাষায় স্টোরিটেলিংয়ে না গিয়ে একদমই সাধারণ শহুরে টান এ সংলাপ গুলো প্রশংসার দাবী রাখেই।
এই কাজটি যদি আপনি দেখতে যান, বুঝবেন। এটাকে আপনি টিভির স্ক্রিনে দেখে মজা পেতেন না। আর অবশ্যই এটা বিগ স্ক্রিনের কাজও নয়। এটা আপনি ল্যাপটপ স্ক্রিনে দেখতে পারেন, এবং সবচেয়ে ভালো হয় স্মার্টফোনে দেখলে। এটা দেখলেই উপলব্ধি করবেন, কেবল ওটিটি প্লাটফর্ম এর জন্যই
বানানো। যার কারণে নির্মাতার সাথে সাথে আমিও 'এটাকে কেবলই হইচই অরিজিনাল বলতে চাই'।
Written By: Saeed Khan Shagor
Re-Edited and Organized By: Ankon Dey Animesh
Comments
Post a Comment