মরণোত্তমঃ সময়ের গল্প বলে যায় || Saeed Khan Shagor & Ankon Dey Animesh ||
একটা গল্পের শুরুতেই দেখা যায় ইমতিয়াজ বর্ষণ হেঁটে হেঁটে কথা বলছেন একজনের সাথে। ''এই সময়ে সব থেকে সস্তা কি?''— এই একটি উক্তি খুব সহজেই আপনাকে প্রবেশ করিয়ে দিবে একটা দারুণ গল্পে। বলছি সদ্য আলোচনায় আসা ড্রামা 'মরণোত্তম' এর কথা। ওটিটি প্লাটফর্ম বঙ্গ বব এ দেখতে পাবেন এটি। সঞ্জয় সমাদ্দারের পরিচালনায় এই ড্রামাটি মূলত লেখক সাদাত হোসাইনের উপন্যাস 'মরণোত্তম' এরই এডাপটেশন। গল্পটিতে পরিচালক বর্তমান সময়কে ধারণ করতে চেয়েছেন; তুলে আনতে চেয়েছেন এই শতাব্দীর বিশেষত বিগত দশকের উদ্ভুত সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতাকে।
একটি গ্রামের স্কুল যার এমপিওভুক্তি প্রয়োজন; তার প্রধান শিক্ষক; একজন স্কুল ছাত্রী; গ্রামের প্রভাবশালী চেয়ারম্যান; ঢাকা শহরের রূঢ় রুপ দেখতে দেখতে বেঁচে থাকা একজন কবির মিশেলে তৈরি হয়েছে স্টোরিটেলিং। একদিকে চেয়ারম্যান এর স্কুল দখলের পরিকল্পনা; অন্যদিকে তার ছেলেরই ঐ স্কুলের একজন ছাত্রীকে উত্যক্ত করা; এসব সামাল দিতে হিমসিম খাওয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অসহায়ত্ব; সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার প্যাঁচালে পড়ে নিজের পরাজয় মেনে নিয়ে শেষে একটা প্রশ্ন রেখে যাওয়ার মধ্য দিয়েই আগাতে থাকে এই গল্প। স্টোরিটেলিং তিনটি স্বতন্ত্র সিক্যুয়েলে সাজানো, এই সময়ের অধিকাংশ ফিকশনাল স্টোরিটেলিংই এভাবেই তৈরি হচ্ছে।
গল্পটা বেশ ভালো হলেও চিত্রনাট্যে এসে কিছুটা অসামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া গেছে। অনেক দৃশ্যেই সাসপেন্স তৈরি করতে গিয়ে খানিকটা নড়বড়েই হয়ে গেছে গল্পের ধরণ। আবার কোথাও কোথাও স্পষ্টই অনুমান করা যাচ্ছিলো স্টোরিলাইন কোনদিকে যাবে পরের মুহুর্তে যা কিছুটা একঘেয়ে করে দেয় স্ক্রিনিং। আর সবচেয়ে বড় কনফিউশন তৈরি করেছে মূল চরিত্র ঠিক কে; সে ব্যাপারে। স্ক্রিপ্টরাইটার বাধ্য নন তা বুঝিয়ে দিতে, কিন্তু এই কনফিউশান নিয়ে কথাটা হয় দর্শকজগতেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি খেয়াল করেছি কোহিনুর তথা অভিনেত্রী মাহিমাকেই অনেকে মূখ্য চরিত্র বিবেচনা করেছেন। আদতে এই ড্রামায় মূখ্য চরিত্র আসলে স্কুল প্রধান শিক্ষক ইলিয়াস কাঞ্চনই। তার প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ব্যতীত এই ড্রামায় প্রাণই থাকে না।এবার আসি ডিরেকশনের কথায়। ফ্রেমিংগুলো ভালো সাজাতে পারেন নি সঞ্জয় সমাদ্দার। অনেক জায়গাতেই যেমন- কবি যখন অনশনরত স্কুল শিক্ষকের কাছে আসেন তখন একটা লং ডিউরেশন ধরেই কবির অবয়ব অস্পষ্ট (যদিও এর আগে ভীড়ের মধ্যে কবির পূর্ণ অবয়ব দেখা গেছে)। সেসব ক্ষেত্রে তার ক্যামেরা মুভমেন্ট আরেকটু ওয়াইড হওয়া প্রয়োজন ছিল। কোথাও কোথাও ফোকাসিংয়ের সমস্যাও দেখে গেছে। কিন্থ পরিচালক যে কারণে অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার তা হলো ক্লোজ শট, লং শট আর ড্রোন শটের দারুণ এক কম্বিনেশান। এই ব্যালেন্স করাটা পূর্বের বর্ণিত খুঁতগুলোকে চাপা দিয়ে দেয়। মিউজিক ডিরেকশনও ভালোই, শুনতে একটা আবহ কাজ করছিল; যদিও সাউন্ড মিক্সিং আর ডাবিংয়ে স্পষ্ট অনেক ভুল দেখা গেছে।
অনেকগুলো দৃশ্যেই ক্যারেক্টারের ভয়েসটা যথাযথভাবে পাওয়া যায় নি; কোথাও কোথাও সাধারণ শ্রাব্যতা সীমারও নীচে। এডিটিংকেও মনে হয়েছে কাঁচা হাতে করা। যেমন ঢাকা শহরের রাতের ড্রোন শট দেখাতে গিয়ে ভাইব্রেন্সটা কমে গেছে এডিটিংয়ে। শেষের দিকে স্কুল শিক্ষকের পুড়ে যাওয়ার ভিজুয়ালাইজেশনটা মোটেও প্রানবন্ত ছিল না। এটা এমনিতেই চ্যালেঞ্জিং কাজ। পরিচালক এই দৃশ্যকে চাইলেই কোহিনুরের ফাঁসির মতো ছোট একটা শট দিয়েই স্কিপ করতে পারতেন। কিন্তু সে জায়গায় বাজে এডিট এর কারণে দর্শক গল্পে সমব্যথিত হওয়ার মুহুর্তেই খানিকটা বিরক্তির ভ্রুক্ষেপ করবে ধারণা আমার। আর এক ফিল্মের সাথে আরেক ফিল্মের বা এক শটের সাথে আরেক শটের মিক্সিংয়ের সময়েও গ্যাপ চোখে পড়েছে।
'মরণোত্তম' কিছুদিন প্রাসঙ্গিক থাকবে এখানকার দারুণ দারুণ কিছু ডায়ালগ ডেলিভারির কারণে। অবশ্য এই ডায়ালগের সবগুলোই এসেছে ইমতিয়াজ বর্ষণের রোল প্লে থেকে। বর্ষণ স্বল্প সময়েই তার অভিনয়ের উচ্চতা যে কত বেশি তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় ব্যত্যয় ঘটান নি 'মরণোত্তম' এ এসেও। প্রতিটা দৃশ্যেই তিনি প্রাণবন্ত। তার চাহনি নিখুঁত। তার বাচনভঙ্গি চমৎকার। গল্পকে নিজের মাঝে ধারণ করার এক দারুণ প্রতিভা তার আছে। 'ব্ল্যাকবোর্ডে মানুষ কি লিখে জানেন?....', 'যেখানে জীবনের চেয়ে মৃত্যু উত্তম', 'আচ্ছা বলেন তো এই সময়ে সবচেয়ে সস্তা কী?....' এই ডায়ালগগুলো অনেকদিন দর্শকের হৃদয়ে গেঁথে থাকবে।
প্রায় ছয়বছর পর ইলিয়াস কাঞ্চন অভিনয়ে ফিরেছেন। তিনি একজন জাত অভিনেতা। স্বাভাবিকভাবেই তার অভিনয় পরিণত। কিন্তু ডায়ালগ ডেলিভারি কিছুটা স্লো; অন্তত ২০২১ সাল বিবেচনায়। আঞ্চলিক/প্রমিত ভাষার টানের একটা মারপ্যাঁচেও আটকে গেছেন কিছুটা। আর গ্রামের অসহায় স্কুল শিক্ষকের হাতে টাইটানের ঘড়ি বিদঘুটে লাগছিল খানিকটা। তবে পরিচালক বাহবা পাবেন যে ইলিয়াস কাঞ্চনকে আমরা বাস্তব জীবনে দেখতে পাই, সেই বাস্তব জীবনের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ইলিয়াস কাঞ্চনকেই তেমনই একটি চরিত্রে হাজির করানোয়। স্ক্রিনিং তুলনামূলক কম সময়ের জন্য থাকলেও শহীদুজ্জামান সেলিম তার রোল প্লেয়িংয়ের পুরোটা সময়ই শক্তিশালী ছিলেন। প্রফেশনালিজম ধরা দিচ্ছিল তার প্রতিটা অভিব্যক্তিতেই। কোহিনুর চরিত্রে মাহিমাও দিয়েছেন তার সেরাটা।
'মরণোত্তম'কে এক নজরে বলতে চাইলে বলতে হয় স্লো কাজ; অবশ্য সোশ্যাল ড্রামা হিসেবে এই গতির কাজ মন্দ নয়। সম্ভবত খুবই স্বল্প সময়ের মাঝেই তার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। তড়িঘড়ি চোখে পড়ার মতোই। পরিচালক সেখানে একটা মেসেজ দিতে চেয়েছেন, যা সংলাপনির্ভর নয়; গল্পনির্ভর। যেখানে আমাদের বর্তমান সময়ের সামাজিম সমস্যা— ইভটিজিং, নারীর নিরাপত্তাহীনতা প্রভৃতি আর রাজনৈতিক সমস্যা— ক্ষমতার প্রভাব, আইনের শাসন না থাকা এসবের ছায়ায় উদ্ভুত নাগরিক সমস্যা— নির্লিপ্ততা, স্বার্থপরতা, আইনের মারপ্যাঁচ আর অবশ্যই ভার্চুয়াল লাইফের অপব্যবহার এবং ব্যবহার নিয়ে শক্তিশালী একটি মেসেজ দিতে পেরেছেন তিনি। এটা সাহসী কাজ। দর্শককে ভাবাবে। এমন কাজ আরো হওয়া উচিত। আরো প্রফেশনালিজম নিয়ে। পরিচালক এই গল্পে কোনো ফিনিশিং বা কনক্লুসন দেন নি সে অর্থে। তিনি দেখান নি অপরাধীরা ধরা পড়েছে বা তাদের বিচার হয়েছে। এ যেন বর্তমান সময়ের কথাই বলে। যেখানে অপরাধ হয়, প্রতিবাদ হয়। কখনো অপরাধী ধরা পড়ে, কখনো বা সবকিছুর পরও চোখের সামনে দম্ভের সাথে ঘুরে বেড়াতে পারে অপরাধীরা।
হ্যাঁ! 'মরণোত্তম' সময়ের গল্প বলে যায়।
Written By: Saeed Khan Shagor
Edited By: Ankon Dey Animesh
Collected From: Desh Rupantar
Comments
Post a Comment