দাস কেবিন থেকে আমি অংকন বলছি || Ankon Dey Animesh
কেউ যদি আমাকে দাস কেবিন সম্পর্কে একটা শব্দ বলতে বলে আমি বলব “অসাধারণ”, আর কেউ যদি আমাকে দাস কেবিন সম্পর্কে আমার যা বলার তা বলতে বলে তাহলে তাকে হয়ত আমি বলব পুরো একটা বিকেল ফ্রি রেখে একদিন দেখা করতে আসতে, আলাপ দেওয়ার জন্য।
দাস কেবিন আমার কাছে সম্পর্ক, সময়, মানব-মন, আপেক্ষিক মূল্য এবং চাহিদার গল্প তুলে ধরা নাটক/ফিল্ম। মেঘের কাছাকাছি যদি আপনার বাসার বারান্দা হয়, তাহলে মাসুদ হাসান উজ্জ্বল ভাইয়ার অন্যান্য কাজের মত এই কাজও আপনার আইডেন্টিটি এবং জীবনবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। কর্পোরেট সিঁড়ি ধরে উঠতে থাকার বাসনায় থাকলে নিচের দিকে একটা টান অবশ্যই অনুভূত করাতে পারে। দাস কেবিনকে আমি ৫ বছর পরেও মনে রাখব এর সংলাপ, ক্যারেক্টার পারফরম্যান্স, ক্যামেরা ফ্রেমিং এবং গল্প-উদ্দেশ্য এর জন্য।
দাস কেবিন এর সবথেকে শক্তিশালী অংশ হল তার সংলাপ। মাসুদ হাসান উজ্জ্বল এর অন্যান্য কাজের মত এই কাজেও তিনি তার সঞ্চিত জ্ঞানকে ছবির সংলাপের মাধ্যমে তার দর্শকমহলে পৌছে দেন। ছবিতে আপনি Harvard Business Review এর কর্পোরেট বা এন্ট্রেপ্রেনারিয়াল মডার্ন এডভাইস এবং এনালাইসিস যেমন পাবেন, পাবেন Das Capital এর আলোচনাতত্ত্বের এক্সটেনশনও। এই শক্তিশালী সংলাপ লেখনী আপনাকে রিলেট করাবে ক্যারেক্টারদের সাথে। এবং যদি আপনি জ্ঞানপিপাসু অথবা স্যাপিওসেক্সুয়াল ক্যাটাগরিতে নিজেকে আইডেন্টিফাই করতে পারেন, তাহলে সংলাপগুলোকে অসাধারণ মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। মাসুদ হাসান উজ্জ্বল ভাইয়া তার ছবির প্রগতিশীল ও তথাকথিত “যাযাবর-শ্রেণী”র রিপ্রেজেন্টেটিভ ক্যারেক্টারদের জন্য শক্তিশালীভাবে ডায়লগ এবং ক্যারেক্টার আর্ক বানিয়ে থাকেন, সেটা আমি লক্ষ করেছি।
যদিও সংলাপ বা ক্যারেক্টার শক্তিশালীভাবে লেখা, তারপরেও অভিনেতার অভিনয়শৈলীর অভাবে সেই লেখা নষ্ট হয়ে যেতেই পারে। কিন্তু শৈবাল চরিত্রে আজাদ আবুল কালাম ভাইয়া তার দক্ষ অভিনয় দিয়ে সেই সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দিয়েছেন। তার উচ্চারণ, ডায়লগ ডেলিভারি, এক্সপ্রেশন- সব কিছু ছিল অসাধারণ। এমনকি সংলাপ চলাকালীন তার থামার জন্যে নেওয়া গ্যাপ, বা কখনো গ্যাপ না নিয়ে টানা বলে যাওয়া, অথবা তার চোখের নড়াচড়া- তিনি যে এই ক্যারেক্টারের মধ্যে ভালোভাবেই ঢুকে গিয়েছিলেন তা বোঝা যায়। মাসুদ হাসান উজ্জ্বল ভাইয়ার প্রেম, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, প্রোলেতারিয়েত সংগ্রাম নিয়ে লেখা সংলাপগুলো তার মুখ নিঃসৃত হয়ে অদ্ভুত রকমের পূর্ণতা পেয়েছে। প্রথমবার দাস কেবিন দেখার সময় যে অংশগুলোতে আমি তার দিকে অবাক ভাবে তাকিয়ে ছিলাম, তা ছিল কিছুটা এরকম-
“তারপর ও তুমি বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হবে, নানান ছুতো খুঁজবে তাকে ভালো লাগানোর। কিছু কিছু ব্যাপারে তোমাদের মতের মিল হবে, সেই মিল কে মনের মিল ভেবে ভ্রম হবে। তারপর এসবের ভেতর দিয়েই একগাদা ছেলেপেলে পৃথিবীতে চলে আসবে, শুরু হয়ে যাবে নতুন মুখের ক্ষুদা জয়ের সংগ্রাম”।
সাবরিনা চরিত্রে শার্লিন আপুর অভিনয় ও নজর কাড়ার মত। “আপনার কখনো সংসার করতে ইচ্ছে হয় না?” বলার সময়ে তার চোখের আকুতি, কিংবা “আমার মনে হচ্ছে আমি কেবল এক সিঁড়ি বেয়ে উঠছি”তে তার উদাসীনতা, অথবা “আমি যদি আবার ফিরে আসতে চাই?” এ তার বিসর্জন দিয়ে দেওয়া মন আপু অদ্ভুত সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্পে তাকে দুটো ভিন্ন শেডে দেখা গেছে। একখানে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, অন্যখানে সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে নিজেকে সঁপে দিয়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। দুটো জায়গাতেই তিনি অসাধারণ। তার থেকেও বেশি অসাধারণ লেগেছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে তিনি ঢুকে যাবেন কিনা সেই কনফিউজড অবস্থাতে।
জায়েদ চরিত্রে ইরেশ জাকের ভাইকেও যথাযথ লেগেছে। জাকের ভাইয়ের রোলে তার এক্সট্রা করার মত কিছু ছিল নাহ। ভাইয়া যেভাবে ছিলেন সেভাবেই যথাযথ। হয়ত তিনি আরো কিছু এক্সপ্রেশন ডেভেলাপ করতে পারতেন শারলিন আপুর সাথে তার কনভার্সেশনের সময়ে, বা হয়ত আরো কিছু গ্যাপ নিতে পারতেন। ভাইয়ার অভিনয় খারাপ কোনোদিক থেকেই নাহ, তবে অনেকাংশে হয়ত বেটার করতে পারতেন নিজেকে এই দাস কেবিনে।
এই ছবির ওয়াইড রেশিওটা এখানে একটা বড় প্লাস ফ্যাক্টর। সাধারণত ক্যারেক্টার কেন্দ্রিক ফিল্মে এত ওয়াইড রেশিও ব্যবহার হয় নাহ, ক্যারেক্টার কেন্দ্রিক ফিল্মে অব্জেক্ট সেন্ট্রালাইজ করার জন্য একটু বেশি কম চ্যাপ্টা (সহজ ভাষায় বললাম আর কি :3) করার চেষ্টা করা হয় স্ক্রিন সাইজ কে। নরমালি যখন কোথাও ন্যাচার বা এস্থেটিক কিছুকে ছবিতে ধারণ করতে দেখবেন, তখন দেখবেন যে স্ক্রিনটা অনেক ওয়াইড, অনেক বেশি হরিজন্টাল অনুপাত। তো এর থেকেই বুঝা যায় যে মাসুদ ভাইয়ার ইচ্ছা ছিল যত বেশি সম্ভব জিনিসটাকে তথাকথিত এস্থেটিক ক্যাটাগরিতে ফেলে আজাদ ভাইয়ার চরিত্রকে উজ্জ্বল করে সেই ফ্রেমে জাকের ভাইয়ার স্ক্রিন অসামাঞ্জস্যতা বুঝাতে। তাই ফ্রেম গুলো দেখতে সুন্দর লাগছে, ডায়লগের ওটিএস শট গুলাও অনেক ওয়াইড লাগছে, সেট ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো হওয়ায় জিনিসটা একদম ই খারাপ লাগছে নাহ আর।
Written and Edited By: ANKON DEY ANIMESH
Written and Edited By: ANKON DEY ANIMESH
এই ছবির গল্প, স্ক্রিনপ্লে সুন্দর এবং মৌলিক। বস্তুচিন্তাকারী মানুষের মনে ছোট আলোড়ন তোলার চেষ্টা “যে জীবন ফড়িং এর” ছবির মত এখানেও করেছেন মাসুদ হাসান উজ্জ্বল ভাইয়া। কার জীবনদর্শন ভুল, কার ঠিক- তা নিয়ে প্রশ্ন ও আলাপ চলেই আসে। আর সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বরঙ প্রশ্নটাকে আন্সল্ভড রাখতে প্রটাগনিস্টকে মেরে ফেলে থিম-প্রধান ছবিতে কনভার্ট করতে চাওয়ার চেষ্টাটাও সফল বলেই মনে হয়েছে। যাদের মনে প্রশ্ন ছিল নাহ, তারাও হয়ত এটি দেখে ভাববে, ভাবা শিখবে; এবং সব থেকে বড় বিষয়ঃ প্রশ্ন করা শিখবে।
এই ছবির যেদিকটা আমার ব্যক্তিগতভাবে অতটা ভালো লাগেনি তা হল এর সাউন্ড ডিজাইন। হয়ত সেটা সাউন্ড ডিজাইনার এর ব্যক্তিগত চয়েস, বাট আমি হলে আমি ভিন্নভাবে করতাম। ডাবিং এর ক্ষেত্রে কিছু ভুল অনেক বারই দৃশ্যমান হয়েছে। আবার অনেক সময় ডাবিং এর ভুল ঢাকতে যে আউটডোর মাইক ইউজ করা হয়েছে, সেটির সাউন্ড আনার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে দুটো একসাথে মিক্স হওয়ায় তা অল্প শ্রুতিকটু লাগে আমার কানে। মাঝে মাঝে এই শ্রুতিকটু জিনিসটাকে ঢেকে দিতে তিনি বিজিএম ইউজ করার চেষ্টা করেছেন, এই চেষ্টা অবশ্যই ক্রিয়েটিভ। তবে আমার এই জিনিসটা নিয়ে একটু মন খুঁতখুঁত থেকেই যাবে। আর বিজিএমের কথা যখন এলো, এটাও সেই সাউন্ড ডিজাইনার এর পার্সোনাল পার্স্পেক্টিভ। আমি একটু ভিন্নভাবে করতাম। কিছু কিছু জায়গায় অবশ্য আমার সাউন্ড এবং গান অনেক ভালো লেগেছে, সেটা অস্বীকার করব নাহ। তবে বেশ কিছু জায়গা আমার সাউন্ড ফিলোসফির সাথে যাচ্ছিল নাহ, সেটা না যাওয়াটা অস্বাভাবিক নাহ। আমার দিক থেকে নেগেটিভ পয়েন্ট এগুলাই চোখে পড়েছে। ডিটেইলিং বা কন্টিনিউটি এরর খুঁজার চেষ্টা করিনি, খুঁজলেও হয়ত পাব নাহ, দেখে ভালো কাজ ই মনে হয়। ইভেন সাউন্ড ছাড়া অন্য কোনো ডিপার্ট্মেন্ট নিয়ে আমার কোনো নেগেটিভ ভাইব মাথায় ও আসে নি দেখার সময়- দর্শক হিসেবে।
সবশেষে বলতে চাই, দাস কেবিন একটি অত্যন্ত ভালো কাজ। রিসেন্টলি দেখলাম যে এটি ইউটিউবেও এভেইলেবল আছে। যে কেউ চাইলেই এখন দেখে নিতে পারে। এবং দেখা উচিত। দাস কেবিন টিমকে অনেক গুলো ভালোবাসা, ভালোবাসা মাসুদ হাসান উজ্জ্বল ভাইয়ের জন্য, জাকের ভাইয়ার জন্য, আজাদ ভাইয়ার জন্য এবং শার্লিন আপুর জন্য।
Written and Edited By: ANKON DEY ANIMESH
Written and Edited By: ANKON DEY ANIMESH
Written and Edited By: ANKON DEY ANIMESH
Comments
Post a Comment