আমি যেভাবে 'লাইভ ফ্রম ঢাকা'রে দেখি || Saeed Khan Shagor || Ankon Dey Animesh



''তুমি আমাকে ফেলে কোথাও যেতে পারবে না সাজ্জাদ'', রেহেনার এই উক্তি যেন নিষ্পেষিত শহর ঢাকারই উল্লাস ধ্বনি। 'লাইভ ফ্রম ঢাকা' মুভিতে ঢাকা সাজ্জাদকে অনিশ্চয়তার গহীন অন্ধকারে নিমজ্জিত করে ফেলার পরে আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল পালানোর সুযোগ নেই।



আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ এর কাহিনী, চিত্রনাট্য এবং  পরিচালনায় এই মুভিটি প্রিমিয়ার হয় ২০১৯ সালে। ঢাকা এবং ঢাকাকে ঘিরে জীবনচক্রের এক ঘোরে মানুষের আটকে যাওয়ার গল্প নিয়ে 'লাইভ ফ্রম ঢাকা'। ফ্লাইওভারে ঘেরা এই শহর যেমন মানুষের চোখ মেলে আকাশ দেখার সম্ভাবনাকে সংকুচিত করে দিয়েছে তেমনই আর্থসামাজিক পরাবাস্তবতায় ক্রমশ নীচে নেমে আসছে মাথার ছাদ। সেই ক্রমশ ছোট গন্ডিতে আবদ্ধ হয়ে যাওয়া জীবন আর জীবনের সাথে যুদ্ধের খেলায় খেই হারিয়ে ফেলে স্বার্থপর হয়ে উঠা চরিত্র সাজ্জাদ। ঢাকা শহরে মফস্বল থেকে আসা অধিকাংশ মানুষই টাকা উপার্জনের স্বপ্ন নিয়ে হাজির হয়। তারপর ঢাকার টাকার ওড়া ফাঁদ এ পড়ে মানুষ আরো বড় হতে চায়। অনেকেই পারে না। আটকে যায়। হেরে বসে। আটকে যাওয়াদের সবটুকু কেড়ে নিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয় যারা হারে না তারা। সাজ্জাদ সব হারাতে শুরু করে। লোনের স্তুপে আটকা পড়ে, দরপতন হতে থাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তার শেয়ারের। ক্রমশঃ ক্ষীণ হতে থাকে ঢাকা শহরের যাঁতাকলে তার নিজের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা। এই বাঁচা-মরার খেলায় সে এত বাজেভাবে অবতীর্ণ হয় যেখানে তার কাছে সন্দেহের বস্তু হয়ে উঠে প্রেমিকা। খেই হারিয়ে ফেলা সাজ্জাদ আস্তে আস্তে হারাতে থাকে প্রেমিকা রেহেনাকে, ভাই ড্রাগ এডিক্টেড মাইকেলকে, তার অন্যসব বন্ধুদের।



পরিচালক সাদ সফলভাবে এই হারানো যে আসলে ঢাকার করাল গ্রাস এর মেটাফোর সে হিসেবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। 'লাইভ ফ্রম ঢাকা' দারুণ একটা গল্প। ঢাকার প্রত্যেক উপনিবেশিক মানু্ষ তার ঢাকা দর্শনকে এই গল্পে আবিষ্কার করতে পারবেন। মনে হবে এ তো আপনারই ঢাকা শহর, আপনি যাকে ছেড়ে যেতে পারছেন না। আটকে গেছেন, নিশ্বাস নিতে না পারা সত্ত্বেও। চিত্রনাট্য আরো চমৎকার। সবচেয়ে উপভোগের বিষয় হলো এই মুভির ভাষা। যে ভাষায় আমরা কথা বলি সেই ভাষা। যেখানে নিজেকে শিক্ষিত প্রমাণের জন্য প্রমিত ব্যবহার করতে হয় নাই। কেবল গল্পে একটাই খুঁত, আব্দুল্লাহ সাদ যে সময়টাকে এখানে তুলে ধরেছেন তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেই সবচেয়ে অস্থিরতার সময়। সে রাজনৈতিক অস্থিরতায় ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত সমাজও যে গণজাগরণ মঞ্চ আর হেফাজতের দুই ধারায় বিভক্ত তা তার গল্পে অনুপস্থিত। সে জায়গায় অস্থির একটা ভাবধারা আনতে তিনি হাজির করেছেন ভার্সিটি পড়ুয়াদের দুই গ্রুপে সংঘর্ষকে। আব্দুল্লাহ সাদ যদি সময়কে ধারণ করার কোনো প্রবণতা না দেখাতেন এই মুভিতে তাহলে এই ইস্যুটা সামনে আসতো না অথচ।



শটগুলোও দারুণ। বেশিরভাগই ওয়াইড লেন্সে এবং লং শটের দৃশ্য হলেও স্ক্রিনপ্লে একটা মনোরোম পরিবেশনা উপহার দিতে পেরেছে। ক্লোজ শটে বেশ কিছু ফ্রেমিং মানানসই মনে হয়নি। সে অনুপাতে লং শট গুলো, ক্যামেরার মুভমেন্ট গুলো বেশ দারুণ ছিল। এই মুভিতে বেশ কিছু কনটেন্ট দেখা যাবে যা উঠতি ফিল্মমেকাররা লুফে নিবেন। মশারীর ফাঁকে সিগারেটের ধোঁয়া উঠা, কারের পিছনের সিটে বসে ক্লোজ শট নেওয়া তাও আবার ক্যামেরাকে স্থির না রেখে, এমনকি কত সিমপ্লি ইনডোর এর সেট সাজানো যায় তাও এখানটা দেখে আইডিয়া পাবেন। কেবল কয়েকটা জায়গায় ফোকাসিং স্লো মনে হয়েছে। দুরের ফ্লাইওভার থেকে সাজ্জাদের চেহারায় ফোকাস আনার একটা দৃশ্য আছে খানিকটা এমনই। আদনান হাবিব এবং তুহিন তামিজুল এই কাজগুলোর কৃতিত্বের ভাগীদার। 



এডিটিংয়ে এই মুভিকে একটা সাদাকালো রুপ দেওয়া হয়েছে। এই সাদাকালোটা আবার ভিন্টেজ নয়। খানিকটা ভাইব্রেন্স যুক্ত। এই ধাঁচের মুভি এডিট পাওয়া যাবে মেক্সিকান মুভিগুলোয়। তবে সময়ের আলাপ যেহেতু আছে কালার গ্রিডে এই মুভির এডিটটা করা যেতো। স্ক্রিনপ্লে আর এডিট মিলিয়ে যদি আশিভাগ সাসপেন্স ক্রিয়েট করা যায় তাহলে সাউন্ড মিক্সিং এসে সেটাকে খাপে খাপ একশভাগ এ রুপ দিয়েছে। কখনো কখনো ব্যাকগ্রাউন্ডে আজানের ন্যাচারাল সাউন্ড গল্পের সানপেন্স এ 'মসজিদ এর শহর ঢাকা' এই সত্যকে সামনে নিয়ে আসবে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক যে নিজেই আলাদা এক গল্প বল সেটা 'লাইভ ফ্রম ঢাকা' মুভি দেখিয়ে দেয়। ডাবিংয়ের চাইতে ন্যাচারাল সাউন্ডেই এই ধরণের কাজ ভালো। সেটাই হয়েছে এখানটায়। 




এই গল্পটা আগাগোড়া সাজ্জাদকে উপজীব্য করেই। সাজ্জাদ চরিত্রে মোস্তফা মনোয়ার ভালো সিলেকশান। তার অভিনয়ও দারুণ হয়েছে। বিশেষ করে ক্রাইসিস মোমেন্টগুলোয় তার চেহারার অভিব্যক্তিটা গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে ভেঙে পড়া নেই, আছে ঢাকা শহরে যে করেই টিকে থাকতে হবে; তার জন্য স্বার্থপর হওয়া জরুরী এমন এক ছাপ। তার ডায়লগ ডেলিভারির ফ্লোটাও চমৎকার। যেখানে প্রয়োজন তিনি থেমে গেছেন, যেখানে প্রয়োজন চড়া গলায় আওয়াজ তুলেছেন। কেবল স্টোরিটেলিং খানিকটা স্লো হওয়ায় তার দৃশ্য অনেক অনেক বেশি বলে মনে হতে পারে দর্শকের। ডায়লগ ডেলিভারির পরে বেশিরভাগ সময়েই একই ফ্রেম এর আবেদন কমে আসে। তাই এই গল্পকে যদি আরেকটু ছোট ডিউরেশনে আনা যেতো ভালো হতো।


রেহেনা এই গল্পের একটা উল্লেখযোগ্য চরিত্র। যে সাজ্জাদের প্রেমিকা। রেহেনা চরিত্রে অভিনয় করেছেন তাসনুভা তামান্না। কস্টিউম ডিজাইনার বাহবা পেতেই পারেন অন্তত তামান্নার কস্টিউম আর মেকআপ এর জন্য হলেও। তামান্না দারুণভাবে ঢাকার সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা প্রেমিকার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তার বাচনভঙ্গি, তার চাহনি সবকিছুতেই একটা সাংসারিক টানাপোড়েন এর ছাপ ফুটে উঠেছে। আর সেই সাথে মানুষ এর কাছে ঠকতে ঠকতে সহজ-সরল জীবনেও ট্রাস্ট ইস্যু ক্রিয়েট এর একটা সুন্দর ব্যাপার তিনি নিজের মধ্যে আনতে পেরেছেন। গল্পে গভীরভাবে ডুব দেওয়া ছাড়া তা সম্ভব নয়।



মাইকেল চরিত্রে তানভীর খুব বেশি সাবলীল মনে হয়নি। সাজ্জাদ এর ছোটভাই হিসেবেও দারুণ চয়েজ বলা চলে না। তাদের মধ্যকার এজ ডিফারেন্সটা এখানে ফুটানো যায়নি মোটেও। কিন্তু ড্রাগ এডিক্টেড এই ব্যাপারটায় তানভীর নিজেকে খোলাসা করতে পেরেছেন। উজ্জ্বল আফজাল রোল প্লে করেছেন উজ্জ্বল বা মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার দালাল হিসেবে। এটা একটা ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার। তার অভিনয়ও দারুণ। অভিব্যক্তিতেও একটা যন্ত্র ভাব আছে। সবচেয়ে বড় কথা এই চরিত্রকে প্রভাবশালী করতে পেরেছেন তিনি। আর রনি চরিত্রে রনি সাজ্জাদকেও ভালো বলা চলে।


'লাইভ ফ্রম ঢাকা'কে দর্শক মনে রাখবেন অনেকদিন। আসলে এই মুভি তো নিজের জীবনের এলবাম স্বরুপ। যেখানে আপনি সবদিক, সব বন্ধন আলগা কর‍তে করতে দুঃখবিলাস করার জন্য উঁচু ফ্লাইওভার ছাড়া আর কোনো জায়গা-ই অবশিষ্ট পান না। সাজ্জাদ এই লোন এর কিংবা দায়মুক্তির পরোয়ানা থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারবেন কি না, ঢাকায় আবার বেঁচে উঠতে পারবেন কি না দেখতে হলেও একবার এই মুভি আপনার দেখতে হবে।


Written By: Saeed Khan Shagor
Edited By: Ankon Dey Animesh

Comments

  1. This is the best review of this film so far. Best wishes for the writer and all.

    ReplyDelete
  2. Definitely a bad movie,seems like Saad was trying too hard to make it look like La Haine (1995)

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

চতুর্থ মাত্রা ।। আরাফাত জুয়েল ।। দেবস্মিতা সাহা

The Curious Case of Benjamin Button ।। আরাফাত জুয়েল

ইন দা মিডল অফ "Nowhere" || আরাফাত জুয়েল