মহীনের ঘোড়াগুলির আবেদন ফুরায় না!

 

“মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায়,কার্ত্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে " - জীবনানন্দ দাসের এক কবিতার লাইন। এই কবি নিজে যেমন তাঁর সময়ের বহু আগে চলে এসেছিলেন বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে, তাঁর কবিতা থেকে নাম নেওয়া “মহীনের ঘোড়াগুলি” ব্যান্ডের অবস্থাও  ছিল ঠিক তেমন। সত্তরের দশকে কলকাতার বুকে জন্ম নেয় মহীনের ঘোড়াগুলি। নাম থেকে শুরু করে সৃষ্ট গান-সবেতেই তাদের ছিলো আলাদা পরিচয় আর স্বাদ।  দুর্দান্ত সব গান নিয়ে হাজির হয়েছিলেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়, সাথে ছিল তাঁর দল।  অথচ এই ব্যান্ড কিনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো গুটিকয়েক অনুষ্ঠানের পর গ্রহণযোগ্যতা না পাওয়ার কারণে! সময়টা ছিলো ফিল্মি গানের যুগ। হেমন্ত, আশা ভোসলের মত শিল্পীদের গান তখন খুব চলতো। সেই ধারা থেকে সম্পুর্ণ আলাদা ছিলো মহীনের ঘোড়াগুলি। ব্যান্ডটির বিশেষত্ব হলো - তাদের সমসাময়িক অন্যান্য গানগুলোকে বলা যায় “সেই সময়ের গান”। মহীনের ঘোড়াগুলি-র গানের ব্যাপারে তা খাটে না।

 


বর্তমান তরুণ প্রজন্ম মোটামুটি কলেজে “মহীনের ঘোড়াগুলি” না শুনলেও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কখনো না কখনো লুপে এই ব্যান্ডের গান শোনে, আড্ডা থেকে শুরু করে গ্র্যাজুয়েশন সেরেমনিতে গাওয়া হয় তাদের গান। গানগুলো প্রচন্ডরকম জীবনবাদী, মহীনের ঘোড়াগুলি ভালোবাসার গান শোনায়, তারা জানায় প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা। নগরজীবনে মানুষেরা যেন দালান কোঠার মত খোলসে বাস করে। তাদের সেই খোলস ভেঙে বের করে আনার জন্য মহীনের ঘোড়াগুলি-র গান লেখা। তারা বলে বেড়ায় শহুরে যান্ত্রিকতার বেদনার কথা। অন্ধকার রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা খারাপ মেয়ে হিসেবে পরিচিত  যে মেয়েটির চোখে মুখে দেখা যায় কুটিল হাসি, তার ভেতরে থাকা অসহায় ছোট্ট মেয়েটির গান শোনায় মহীনের ঘোড়াগুলি। গ্রামের পথঘাট যখন জ্যোৎস্নায় ভেসে যায়, সেই সৌন্দর্যের গান গায় মহীনের ঘোড়াগুলি। দক্ষিণের জানালা খুলে দেয় গানের চরিত্র। কলকাতার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গাকে নিয়ে গান গায় মহীনের ঘোড়াগুলি। নদীর মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার অনুসন্ধানী চেষ্টা; নদী সবসময় চলতে থাকে। অথচ নিজেরই দুই তীরে বাঁধা সে। চৈত্রের কাফনে নিজেদের অবহেলায় মুড়িয়ে রাখা স্বপ্নের কথা বলে মহীনের ঘোড়াগুলি। মহীনের ঘোড়াগুলি সবসময় মানববাদী ব্যান্ড ছিল, ব্যান্ড প্রধান গৌতম চটোপাধ্যায় ছিলেন আধুনিক, রুচিশীল, জীবনবাদী এবং কমিউনিজমের সমর্থক। তাঁর জীবন দর্শন ভঙ্গি ছিল অন্যরকম। নিজের সৃষ্ট সুর আর গানের লিপিতে তাঁরই মস্তিষ্কের ছাপ। ব্যান্ডের গানগুলো প্রেমিকাকে প্রাধান্য দেয় নি। প্রাধান্য দিয়েছে মানুষ এবং প্রকৃতিকে। স্বপ্নের অলৌকিক শহর তৈরি না করে অকপটে বলে গিয়েছে  প্রকৃতির সৌন্দর্য আর মানুষের মনের কথা। 



দলটির মধ্যে বিথোফেন, বিটলস, ডিলান, এল্ভিস প্রিসল - প্রমুখ দল আর গায়কের প্রভাব রয়েছে। গানের কম্পোজিশন , আবহ, সুর - সবকিছুতেই সেই সময় ছিল নতুনত্ব। আমেরিকান ফোক, বাঙালি বাউল, জাজ ঘরানার মিশ্র প্রভাব পাওয়া যায় গানগুলোতে। মহীনের ঘোড়াগুলি-র সদস্যরা নিজেদের পরিচয় দিতেন “বাউল জাজ” হিসেবে।  এত রুচিশীল কম্পোজিশন এই সময়ের দলগুলোতে পর্যন্ত খুব কম দেখা যায়। দলের সদস্যরা ছিলেন আমেরিকাপ্রবাসী। দলের সদস্য প্রদীপ চ্যাটার্জী ছিলেন বেজ গিটারিস্ট, ড্রামের দায়িত্বে ছিলেন বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়, তাপশ দাস ছিলেন গিটারে, আর আব্রাহাম মজুমদার ছিলেন ভায়োলিন আর পিয়ানোতে। গৌতম বন্দোপাধ্যায় ছিলেন লিড ভোকাল, স্যাক্সোফোন, লিড গিটার আর সার্বিক দায়িত্বে। রঞ্জন ঘোষাল দেখতেন মিডিয়া রিলেশনের দিকটা। কমবেশি সকলেই ভোকাল দিতেন।  শুধুমাত্র গানের টানে তারা ফেরত এসেছিলেন কলকাতায়। অথচ সময়ের বহু আগে জন্ম নেওয়ায় সেই সময়ে তারা তাদের প্রাপ্য স্থান পায়নি। 



ব্যান্ডটি সত্তরের দশকে জন্ম নেয়, ভেঙে যায় আশিতে। দলের সদস্যরা যার যার জীবনে ব্যাস্ত হয়ে পরেন। নব্বই এর শেষে এসে  আবার বছর কুড়ি পরে- নামে গৌতম চট্টোপাধ্যায় পুনরায় কভার করলেন পুরোনো গান। নব্বই দশকের শিল্পীদের দিয়ে তিনি কভার করিয়েছিলেন মহীণের ঘোড়াগুলির পুরোনো গান, নিজের লেখা নতুন কিছু কমপোজিশন। সেই বছর কুড়ি পরে- নামটিও নেওয়া জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে। গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের সাথে দেখা হয় প্রেসিডেন্সির ছাত্র সুব্রত ঘোষের। সুব্রত ঘোষসহ তৎকালীন কিছু শেকল ভাঙতে চাওয়া তরুণের অনুপ্রেরণায় তৈরি হয়েছিলো “পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে”, “টেলিফোন” এর মতো গান। গৌতম চট্টোপাধ্যায় হঠাত করেই মারা যান ১৯৯৯ সালে। বেঁচে থাকলে হয়তো আরো অনেককিছু দিয়ে যেতে পারতেন শেকল ভাঙতে চাওয়া গানের জগতে। 




মোট তিনটা এলবাম বের হয় মহীনের ঘোড়াগুলি-র সত্তর দশকের সময়টাতে -  "সংবিগ্ন পাখিকুল", "দৃশ্যমান" আর "অজানা উড়ন্ত বস্তু"। পরবর্তীতে আসে “আবার বছর কুড়ি পরে”। তপেশ বন্দোপাধ্যায় দল ছেড়ে গেলে পরে আসেন রাজা ব্যানার্জী।  মহীনের ঘোড়াগুলি শুধু একটি ব্যান্ড ছিল না। ছিল একটি প্ল্যাটফর্ম। তাদের ব্যানার ছিলো সকলের জন্য উন্মুক্ত। কোনো এক জনরায় আটকে না থেকে বিভিন্ন জনরার গান গেয়েছে তারা। সত্তর দশকে কলকাতায় অনেকগুলো “লাইভ পারফর্মেন্স” করেছে মহীনের ঘোড়াগুলি। রবীন্দ্র সদন, সটার থিয়েটার, টালিগঞ্জ ক্লাব, কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল জাজ ফেস্টিভেল, ম্যাক্স মুলার ভবনসহ আরো বেশকিছু  "লাইভ পারফর্মেন্স" দেয় তারা।  


জন্মলগ্নে খুব বেশি “ভাও” না পাওয়া এই ব্যান্ডের গান কভার করেছে ফসিলস, ইনসোমনিয়া, চন্দ্রবিন্দু, লক্ষ্মীছাড়া আর ভূমির মতো ব্যান্ডগুলো। মহীনের ঘোড়াগুলিকে “ট্রিবিউট” করে করা হয়েছে কলকাতা ও বাংলাদেশে। ২০১৯ সালে কুয়েটে আয়োজন করা হয় ঝরা সময়ের গান - স্মৃতির মলাটে মহীনের ঘোড়াগুলি। এই সময়ে এসেও অর্ধশত বছর আগের এই ব্যান্ডের গান কিংবা সুর - কোনোটিই পুরোনো হয়ে যায়নি। এখনো এই ব্যান্ডের আবেদন রয়েছে শুধুমাত্র এর অনবদ্য সুর, গানের কথা আর প্রচন্ডরকমের জীবনবাদীতার জন্য। ব্যান্ডটির গানগুলো প্রতি যুগের জন্যই নতুনত্বের স্বাদ দেয়। বাস্তব জীবনে মানুষের থাকে দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, সুপ্ত ইচ্ছা, মৃত ভালোবাসা, বাঁধাধরা জীবন ভাঙার চেস্টা। এই জায়গাতেই মহীনের ঘোড়াগুলি অনবদ্য।



হাহাকার শোনা যায় তাদের গানে,

“আমি তাইতো এখনো খুজি সে দেশ, জানি নেই অবশেষ, মরীচিকা হায়, স্বপ্ন দেখায় 


শৈশবে আর ফেরা যাবে না তো, নেই পথ আর হারিয়ে গেছে সে দেশ -"




“মহীনের ঘোড়াগুলি” তাই এখনো মানুষ শোনে। আয়নার মত তাঁরা তুলে ধরে মানুষের মন, মনের সুপ্ত ইচ্ছাগুলিকে। তাই “মহীনের ঘোড়াগুলি” পুরোনো হয় না। ফুরিয়ে যায় না এর আবেদন।

লেখাঃ হৃদি বিশ্বাস 

নির্দেশনাঃ সাইদ খান সাগর

সম্পাদনাঃ দেবস্মিতা সাহা

Comments

Popular posts from this blog

চতুর্থ মাত্রা ।। আরাফাত জুয়েল ।। দেবস্মিতা সাহা

The Curious Case of Benjamin Button ।। আরাফাত জুয়েল

ইন দা মিডল অফ "Nowhere" || আরাফাত জুয়েল