ফসিলের কান্না ।। আরাফাত জুয়েল ।। দেবস্মিতা সাহা

 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক অনেক সিনেমাটোগ্রাফি বানানো হয়েছে, ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন ভিন্ন গল্পে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক। তবে এসবের মাঝে নতুনত্বের বেশ ঘাটতি লক্ষ করা যায়। ফসিলের কান্না সেদিক থেকে পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক মনে হয়নি আমার। মুক্তিযুদ্ধ এখানে একটা প্রেক্ষাপট বটে, কিন্তু এটি মূলত একটি নিরন্তর ভালোবাসা এবং প্রতিশোধপরায়ণতার গল্প।



রাতের অন্ধকার যেন দুনিয়ার সকল প্রতিকূলতা এবং নৃশংসতার মঞ্চ। কথাটা সবসময় সত্যি না জানি তবে বেশিরভাগ সিনেমাটোগ্রাফি বা সাহিত্যে আমরা সেটাই দেখতে পাই। তেমনি এক ঘোর রাতে তোফাজ্জল হোসেনের সুন্দর সংসারে অন্ধকার নেমে আসে। তার বাড়িতে হানা দেয় কিছু মিলিটারি এবং রাজাকার, তারা তোফাজ্জল হোসেনের স্ত্রী শেফালীকে ধরে নিয়ে গিয়ে বাঁধে শেফালীরই লাগানো শিলকড়ই গাছের সাথে, এবং সেখানে তাকে ধর্ষণ এবং অতঃপর হত্যা করে। এই পুরো ঘটনা ঘটে যুবা তোফাজ্জল হোসেনের চোখের সামনে, সে সেদিন কিছুই করতে পারে না মানবীয় ভয় এবং আতঙ্কের জন্যে। কিন্তু এই বেদনা সে ধরে রাখে, তাঁর স্ত্রীর এই করুণ পরিণতির কষ্টে সেই শিলকড়ই গাছকেই সে মেনে নেয় নিজের স্ত্রী হিসেবে, তারই সাথে চলে তার জীবনসংসার। বহুবারই তার জমি আত্মসাতের প্রচেষ্টা চলে গ্রামের মেম্বার কতৃক, যার জন্যে শিলকড়ই গাছটিকে কাটার প্রয়োজন। এই কারণে তোফাজ্জল হোসেন, যে ইতিমধ্যে গ্রামবাসীর মাঝে একটা পাগল ফিগারে পরিণতি হয়েছে, জীবন কাটায় এই গাছ এবং হাতে একটা দা নিয়ে। সে একবার শেফালীকে হারিয়েছে, আর হারাতে চায় না। একদিন চায়ের দোকানে শুনতে পায় দেশে রাজাকারদের বিচারকার্য শুরু হয়েছে, প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে ওঠে তোফাজ্জল হোসেন। শেফালী তথা শিলকড়ই গাছটিকে কাঁটাগাছ দিয়ে ঘেরাও করে বিদায় দিয়ে সে রওয়ানা হয় ঢাকার উদ্দেশ্যে, এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অনবগত থেকে যে এই গাছটির সাথে এটাই হতে যাচ্ছে তার শেষ দেখা।



ইন দি মিন টাইম, ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটে শিল্পকার্যে মত্ত্ব হয়ে আছে দুজন স্টুডেন্ট, বিনিতা এবং অয়ন। বিনিতা একজন ভাস্কর, অয়ন তার জুনিয়র, তথাপি দুজনের মাঝে আছে বেশ ভাব এবং ভালোবাসা। একদিন বিনিতা একটি ভাস্কর্য বানাতে গিয়ে দেখে তাঁর বাটালি কোথাও গিয়ে আটকে যাচ্ছে, অনেক প্রচেষ্টার পর সে কাঠের ভেতর থেকে যা পায় তার অর্থ তার বোঝা এখনও বাকি ছিল। ক্রমেই কাহিনী খোলাশা হয়ে ওঠে, উন্মোচিত হয় এক করুণ দৃশ্য। 


এই নাটকে লিড রোলগুলোতে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা সব অভিনেতা অভিনেত্রীরা।  তোফাজ্জল সাহেবের পাগলাটে স্বভাবে বেশ সুন্দরভাবে মানিয়ে নিয়েছেন গাজী রাকায়েত, তার কস্টিউম এবং চেহারা চুলের এরেঞ্জমেন্ট ছিল যথাযথ। একজন শিল্পী হিসেবে বেশ একটা গাম্ভীর্যপূর্ণ অভিনয় করেছেন বন্যা মির্জা, ওমর আয়াজের অভিনয়ে ছিল দারুণ সারল্য এবং বাস্তবের ছাপ। যদিও বন্যা মির্জার অভিনয় মাঝে মাঝে কিছুটা ফ্ল্যাট লেগেছে আমার কাছে, কিছু কিছু জায়গায় ছিল এক্সপ্রেশনের ঘাটতি৷ নাটকের ওয়াইড এঙ্গেল সিনারিওগুলোর পাশাপাশি চারুকলার শট এবং বিনিতার স্টুডিওর রেডিশ রিপ্রেজেন্টেশন নাটকে বেশ একটা সুরিয়াল ভাইব এনে দিয়েছে। 


মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের নাটকগুলোতে কেন জানি বারবার আমার কাছে সাউন্ড সিস্টেমের প্রব্লেম ধরা পড়ে। যেমন যখন তোফাজ্জল হোসেন বিনিতা এবং অয়নকে শেফালীর করুণ ইতিহাস নিয়ে বলছিল, তখন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এতটাই বেড়ে গেছিল যে তোফাজ্জলের কথা বোঝা যাচ্ছিল না। রেলস্টেশনে তোফাজ্জল হোসেন যখন হেঁটে যাচ্ছিল, তখন শুটিংকালীন কিছু কথা শোনা গেছে, যদিও সেটা খুব একটা ধরা পড়ে না, তাও খেয়াল করা যায়। শিলকড়ই গাছের চারপাশে কাঁটা বিছিয়ে দেবার পরও কাঠুরেদের সেখানে যেতে কোনো কষ্টই করতে দেখা যায়নি যেটা কিছু অস্বাভাবিক।

 


ফসিলের কান্না ইতিহাসমিশ্রিত একটা শৈল্পিক ভালোবাসার নাটক বলা যাইতে পারে। তবে এর পরিধি আরও বড়। এখানে আপনি যেমন দেখবেন গ্রাম বাংলার মানুষদের রাজনীতি চিন্তা এবং ভোগ দখলদারিত্বের দৃশ্য, তেমন শহরাঞ্চলের বেশ একটা এলিট জীবনযাপনের চিত্র। একজন শিল্পীর শিল্পকার্যে দার্শনিকতার চিত্রের পাশাপাশি একটি সাধারণ মানুষের ভালোবাসার মানুষের ওপর করা অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয়ার দৃশ্য, মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের অন্যান্য অনেক নাটকের মতোই এটাও একটি কমপ্লিট  প্যাকেজ।







Written By : Arafat Jewel
Edited By : Debashmita Saha

Comments

Popular posts from this blog

চতুর্থ মাত্রা ।। আরাফাত জুয়েল ।। দেবস্মিতা সাহা

The Curious Case of Benjamin Button ।। আরাফাত জুয়েল

ইন দা মিডল অফ "Nowhere" || আরাফাত জুয়েল