RUNWAY || Arafat Jewel || Debashmita Saha


 তারেক মাসুদের ফিল্ম দেখার প্রথম মূহুর্তে আপনার তাকে এক ইসলামোফোব মনে হবে, কিন্তু তার ফিল্মগুলো নিয়ে আপনি যত গভীরভাবে ভাববেন, আপনি বুঝবেন ব্যাপারটি আসলে তেমন নয়। তারেক মাসুদ মাদরাসার একজন ছাত্র, তাই তার বেশিরভাগ সিনেমাতে মাদরাসা জীবনের একটা ছাপ দেখা যায়, কখনও তা প্রবলভাবে, অথবা কখনও গৌণ৷ যেমন মাটির ময়নাতে এই চিত্র অনেকটা মূখ্য ছিল, কিন্তু রানওয়েতে ওতটা না। তারেক মাসুদ সবসময়ই চেয়েছেন তার সিনেমাতে সমাজচিত্র ফুটে উঠবে, বাস্তবতা ধরা দেবে। রানওয়ে সেই দিক দিয়ে একটা খুবই সাধারণের মোড়কে অসাধারণ গভীর এক সৃষ্টিকর্ম তারেক মাসুদের, যেটা দিয়ে তিনি শুধু বাংলাদেশের যুবকদের টেরোরিজমের প্রতি টেন্ডেন্সি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন তাইই নয়, বরং তিনি "রানওয়ে" দিয়ে দেখিয়েছেন বাহিরের দেশে আমাদের প্রবাসীদের দুর্দশা, ধনী - দরিদ্রের শ্রেণীবৈষম্য, ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে চড়াহারে সুদ নিয়ে প্রকৃত অর্থে গরীবকে আরও গরীব করার কৌশল সহ আরও অনেক কিছু।


পুঁজিবাদের প্রবল থাবায় দুই পোলার শ্রেণীর মানুষ ক্রিয়েট হয়, ধনী এবং দরিদ্র শ্রেণী। নিজেদের অর্থ এবং দরিদ্রদের কঠোর পরিশ্রমকে পুঁজি করে গড়ে উঠে উচ্চবিত্ত শ্রেণী, অথচ তাদের অত্যাচার এবং নিপীড়নে সে শ্রমদাতারাই হয় দরিদ্র, সর্বহারা। এই শ্রেণী সর্বদা আতঙ্কিত থাকে, কেঁপে ওঠে তাদের বুক ঠিক যেমনটা দিয়ে তারেক মাসুদ শুরু করেছেন তার "রানওয়ে", প্লেন উড়ে যায় আকাশে আর তার আওয়াজ এবং কম্পনে কেঁপে উঠে রানওয়ের পাশে থাকা আশকোনার বস্তির কোনো এক কুঁড়েঘর, ঘুম ভেঙে যায় রুহুলের দাদার, এবং আতঙ্ক নিবারণে পান করে এক গ্লাস জল। একই ব্যাপার দেখা যায় যখন গাড়ি থেকে নেমে আসা ধনী তার নিজের দোষের প্রতি অন্ধ থেকে মেরে রুহুলের মুখ ফাটিয়ে দেয়, রক্তাক্ত রুহুল তার বাড়িতে ফিরতে থাকে, এবং তার মাথার ওপর দিয়ে চলে যায় উচ্চবিত্তদের যান এরোপ্লেন, যেভাবে তারা সবসময় অবিচার করে অনায়াসে থাকতে পারে ধরাছোঁয়ার বাইরে।


ঋণের নামে চড়া সুদে যেটা দেয়া হয়, বেশিরভাগ সময়েই সেটা একজনকে স্বাবলম্বী করতে পারে না, দারিদ্রতা দূর করা তো অনেক পরের বিষয়। আমার ছোট খালার সমিতি থেকে নেয়া ঋণ নিয়েছে তা পরিশোধে তাদের যে কি পরিমাণ কষ্ট এবং অপমান সইতে হয় তা আমি নিজের চোখে দেখেছি। এরই একটা সংক্ষিপ্ত কিন্তু জোরালো রূপ তারেক মাসুদ ফুটিয়ে তুলেছেন " রানওয়ে" দিয়ে। রুহুলের বাবা একমাস হলো ভিটেমাটি বিক্রি করে পাড়ি দিয়েছে কুয়েতে, কিন্তু ইরাকের যুদ্ধ, ততকালীন পরিস্থিতিতে তার কোনো খবর পাওয়া যায় না। এমন আতঙ্ক নিয়ে তাদের গাভীর দুধ বিক্রি করে ঋণের টাকা পরিশোধে আপ্রাণ চেষ্টা করে যায় রুহুলের মা, কিন্তু দারিদ্রতা তাদের ঘুচে না।



গার্মেন্টস সেক্টরে আমাদের দেশের নারীদের একটা বিরাট অংশ কাজ করে। রুহুলের বোনও তাদেরই একজন যে খুব ভোরে তার সহকর্মীকে নিয়ে ঘর ছেড়ে  চলে যায় কাজ করতে, তাদের চারটি পা ক্রমেই গিয়ে যোগ হয় হাজারো পায়ের চলনে, সারাটা দিন কঠিন পরিশ্রম করেও যাদেরকে মালিকরা মাস শেষে ঠিকমতো বেতন দেয় না।




"রানওয়ে" তে তারেক মাসুদ দুই ঘরানার ইসলামকেই দেখিয়েছেন, যার একটা অনেক বেশি উগ্র এবং অপর ঘরানাটা প্রায় তার বিপরীত প্রশান্ত। একটা ছিল জঙ্গীবাদ, অপরটা ছিল তাবলিগি, এদের কোনোটাকেই আমি আদর্শ বলব না, তবে তারেক মাসুদ বেশ সুন্দরভাবেই দুই ঘরানার মাঝের প্রভেদটা বুঝাতে পেরেছেন বলে আমার মনে হয়। টেরোরিজম কখনই নিউট্রাল টার্ম ছিল না। এইচ আলাওলের মতে,

'Terrorism' is a notoriously ambiguous term, which, despite the many attempts at definition and refining, seems rather blunt as a category of analysis. It can never be a 'neutral' concept. As is often repeated (as well as denied), 'one man's terrorist will always be another man's freedom fighter.'


দুঃখজনকভাবে হলেও আমরা সাধারণ মুসলিমরা জিহাদের ব্যাপারে সঠিক ধারণা রাখিনা অনেকসময়ই। শহীদ হওয়ার জন্যে যে সবসময় যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুবরণ করতে হবে সেটাও সত্যি নয়। কিন্তু তবুও ভূ-রাজনীতি এবং মিডিয়ার অপপ্রচারের ফলে টেরোরিজমের সাথে ইসলামের নাম যেমন খুব বেশি জড়াইয়া গেসে, তেমনই সৃষ্টি হয়েছে একটি উগ্রবাদী দলের যারা ইসলামকে ক্ষমতার জন্যে ব্যবহার করে, ব্যবহার করে নৃশংসতার জন্যে। ইসলামের ইতিহাস অনেক যুদ্ধের ইতিহাস সত্য, তবে এটাও মাথায় রাখার বিষয় যে ইসলাম কখনও তলোয়ারের জন্যে প্রতিষ্ঠিত হয়নাই, রেজা আসলান যেমনটা তার বইয়ে বলেন,

Islam, it must be remembered, was born in an era of grand empires and global conquests, a time in which the Byzantines and Sasanians—both theocratic kingdoms—were locked in a permanent state of religious war for territorial expansion. The Muslim armies that spread out of the Arabian Peninsula simply joined in the existing fracas; they neither created it nor defined it, though they quickly dominated it. Despite the common perception in the West, the Muslim conquerors did not force conversion upon the conquered peoples; indeed, they did not even encourage it.


তারেক মাসুদ তার প্রোটাগনিস্ট রুহুলের মাধ্যমে এই প্রভেদ বুঝতে পারার আশা রেখেছেন, যে বুঝতে পারে ইসলামের লড়াইয়ে নিরীহদের হত্যা কখনই ন্যায় হতে পারে না, তা সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম। ইসলামের লড়াই হবে বুদ্ধিবৃত্তিক, দেহজোরের থেকেও বুদ্ধি যেখানে প্রাধান্য, যে লড়াই হবে ন্যায়ের জন্যে, জুলুমের বিরুদ্ধে, এবং যে লড়াই কখনই কোনো নিরীহ মানুষের প্রাণনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াবে না।



এই ফিল্মের বেশিরভাগ মুখই বেশ নতুন বলা চলে। শুধু তিনজন বাদে আর কাউকে আগে দেখেছি বলে মনে হয় না, যার একজন ছিল তিশা (অতিথি শিল্পী), অপর দুজন হলেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় এবং নাজমুল হুদা বাচ্চু। নতুন মুখ হলেও সিনেমার সবারই অভিনয়ে ছিল পরিপক্বতা, কিছু কিছু জায়গায় সঠিক এক্সপ্রেশনের ঘাটতি অনুভব করেছি বটে, রুহুল বা আরিফ দুজনেরই অনেকগুলো এক্সপ্রেশন বেশ ফ্ল্যাট ছিল। এই সিনেমার কোন বিষয়টা আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগসে যদি প্রশ্ন করেন, আমি চোখ বন্ধ করে বলব, সিনেমার চিত্রায়ণ। মিশুক মুনীর এই সিনেমায় চিত্রায়নের যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তা বাংলাদেশের অন্যান্য সিনেমায় আমি খুব একটা বেশি দেখি নাই। কঠিন একটা লোকেশনে কখনও ওয়াইড এঙ্গেলে, লং এবং ক্লোজ শটে এত দারুণভাবে সিনারিওগুলো ফুটে উঠেছে যা দর্শকদের মুগ্ধ করতে বাধ্য। সাথে পেছনে ছিল বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসের লোকগীতি, গ্রাম্যগীতি, যা এই সিনেমাকে একটা পিস অফ আর্টে পরিণত করেছে। 


পরিশেষে এটুকুই বলতে চাই যে তারেক মাসুদ যেটি বলেছেন সেটি অনেক বেশি সত্য, "রানওয়ে" কোনো স্পেসিফিক বোদ্ধা অডিয়েন্সের জন্যে বানানো আর্ট ফিল্ম নয়, বরং এটি গণমানুষের সিনেমা। দেশের সিনেমাপ্রেমিক মানুষেরা তাই এই সিনেমা দেখবে সে আশাই রাখি!






Written By : Arafat Jewel
Edited By : Debashmita Saha

Comments

Popular posts from this blog

চতুর্থ মাত্রা ।। আরাফাত জুয়েল ।। দেবস্মিতা সাহা

The Curious Case of Benjamin Button ।। আরাফাত জুয়েল

ইন দা মিডল অফ "Nowhere" || আরাফাত জুয়েল